অকারণ জরুরতের ডেকে আনা জরুরি অবস্থা — জর্জিও আগামবেন

বোধিচিত্ত
4 min readAug 28, 2021

--

[ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের এই লেখাটা il manifesto তে গত ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে Lo stato d’eccezione provocato da un’emergenza immotivata শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। যে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্য থেকে এই জরুরী অবস্থা কায়েম ও জায়েজ করা হচ্ছে তার একটা ইশারামূলক ব্যাখ্যা এই লেখাটাতে আছে। বর্তমান পৃথিবীতে এমন এক পরিস্থিতিতে এই মহামারীর সাপেক্ষে দেশে দেশে আমরা জরুরী অবস্থার সুতীব্র বাসনা এবং তা কায়েম হতে দেখছি তাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে এই ইশারা কাজের হতে পারে। সন্ত্রাসবাদের বাইরে গিয়েও নজরদারী ও জরুরী অবস্থা আকাঙ্ক্ষিত ও অনুমোদিত হওয়ার একটা অছিলা হিসেবে Covid-19 মহামারী ক্রিয়াশীল আছে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে, যার ভেতর থেকেই মহামারী ডিসকোর্স হাজির হচ্ছে ও তা মোকাবিলায় সে রাষ্ট্রকাঠামোরই প্রাণভোমরা(জরুরী অবস্থা) ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আগামবেনের সাথে পুরোপুরি একমত না হয়েও আমরা এই সমস্যায়ন জারী রাখতে পারি। এই জরুরী অবস্থার দিকে জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে তাকানো মানে বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা নয়, বরং এইরকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের যৌথ অবস্থান কি কি রকমের হতে পারে নিরন্তর তারই অনুসন্ধান হাজির রাখা।]

করোনা ভাইরাস মহামারী মোকাবিলার জন্য যে প্রমত্ত, অযৌক্তিক ও চূড়ান্ত রকমের অন্যায্য জরুরী পদক্ষেপ নেয়া হল তা বুঝতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে ইতালীয় জাতীয় গবেষণা পর্ষদের [The Consiglio Nazionale delle Ricerche(CNR)] ঘোষণা থেকে। এই পর্ষদ ঘোষণা দিয়েছিল যে SARS-CoV2 মহামারী ইতালিতে নেই।

এই ঘোষণায় আরও বলা হল, যেকোন ক্ষেত্রেই “হাজার হাজার কেসের ওপরে ভিত্তি করে অদ্যাবধি মহামারীর যে উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তা অনুযায়ী এই সংক্রমণ ৮০-৯০% কেসে খুবই মৃদু উপসর্গের উদ্রেক ঘটায় (বলতে গেলে, আরেক পদের ফ্লু)। ১০-১৫% কেসের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও বেশিরভাগের গুরুতর কিছু হবেনা। আমাদের হিসাব অনুযায়ী সকল রোগীর মধ্যে মাত্র ৪% এর নিবিড় থেরাপির প্রয়োজন পড়বে।

পরিস্থিতি যদি এইরকমই হয়, তবে গণমাধ্যম এবং প্রশাসন একটা আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে কেন? এমন একটা পরিস্থিতি যা আসল জরুরী অবস্থার উস্কানি দেয় এবং যা চলাচলের ওপরে তীব্র নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ও পুরো অঞ্চলের প্রাত্যহিক জীবনকে রদ করে।

এরকম একটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপকে দুইটা বিষয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

প্রথমত, এখানে আরো একবার জরুরী অবস্থাকে শাসন করার একটা স্বাভাবিক প্যারাডাইম হিসেবে ব্যবহার করার ক্রমবর্ধমান ঝোঁকের বিষয়টা প্রকাশিত হচ্ছে।

“স্বাস্থ্যবিধি (hygiene) এবং গণ নিরাপত্তার কারণে” সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নির্বাহী আদেশ (executive decree) একধরনের আসল আসল সামরিকীকরণ (Militarization)। এই সামরিকীকরণ “তাদের জন্য ঘটে যে সব এলাকায় (Municipalities and areas) অন্ততপক্ষে একজন ব্যক্তির টেস্ট পজিটিভ এসেছে এবং তাদের জন্য যাদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের উৎস চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। অথবা এমন একটা এলাকার জন্য যেখানে কেউ অন্য কোন সংক্রমিত দেশে সাম্প্রতিককালে ভ্রমণ করেছে এমন কারোর সংস্পর্শে আসেনি, অথচ সংক্রমিত হয়েছে সেই সব এলাকার ক্ষেত্রে একধরনের সামরিকীকরণ ঘটে।”

এরকম একটা অস্পষ্ট ও অনির্ণীত ফর্মুলা [সরকারকে] এই জরুরী অবস্থা সকল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত করার সুযোগ করে দিবে। যেহেতু এটা বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব যে একই পরিস্থিতি অন্য জায়গায় তৈরি হবেনা।

এই নির্বাহী আদেশের ফলে স্বাধীনতার ওপরে যে প্রচন্ড নিয়ন্ত্রন জারী হবে তা নিয়ে ভাবা যাকঃ

১। সকলের জন্য আক্রান্ত এলাকা থেকে বের হওয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা;

২। আক্রান্ত এলাকায় ঢোকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা;

৩। সকল উদ্যোগ ও আয়োজনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা (হোক সেটা সংস্কৃতি, খেলাধূলা, ধর্ম অথবা বিনোদনসংক্রান্ত)। আবদ্ধ জায়গা সহ ব্যক্তিগত ও জন পরিসরে যেকোন সমাবেশ যদি তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকে তার ওপরে নিষেধাজ্ঞা;

৪। দূর-শিক্ষণ কার্যক্রম বাদে উচ্চ শিক্ষা সহ কিন্ডারগার্টেন ও সকল পর্যায়ের বিদ্যালয়ের শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম রদ;

৫। ‘কালচারাল হেরিটেজ ও ল্যান্ডস্কেপের ধারা’র ১০১ নম্বর আর্টিকেল ও ১/২২/২০০৪ এর ৪২ নম্বর নির্বাহী আদেশে যে সকল জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত আছে তা বন্ধ ঘোষণা। এই সকল প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার অবাধ প্রবেশাধিকারের নিয়ম রদ;

৬। ইতালী ও এর বাইরে সকল প্রকার শিক্ষা সফর রদ;

৭। জনপরিসরের গৃহীত সকল পরীক্ষা রদ। জনপরিসরে নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা কার্যক্রম (essential services or public utility services) বাদে সকল প্রকার গণ কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া;

৮। যেই সকল ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তির কাছাকাছি ছিলেন তাঁদের ওপরে কোয়ারেন্টাইন ও নজরদারী আরোপ করা।

জাতীয় গবেষণা পর্ষদের মতে যেটা একটা সাধারণ ফ্লু, এবং যে সকল ফ্লু আমাদের প্রতি বছর আক্রান্ত করে তাঁর থেকে খুব একটা আলাদা না সেই ফ্লু-এর হুমকির সাপেক্ষে এরকম পদক্ষেপ নেয়া যে অসাঞ্জস্যপূর্ণ তা পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়।

আমরা এটা বলতে পারি যে, জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের (Terrorism) দোহাই যখন আর দেয়া যাচ্ছেনা, সেই মুহুর্তে এরকম জরুরী পদক্ষেপের সীমাহীন বিস্তৃতির জন্য একটা মহামারির উদ্ভাবন সবচাইতে আদর্শ ছুতো তৈরি করে দিতে পারে।

আরেকটা যে বিষয় আছে সেটা হচ্ছে ভয়ের পরিস্থিতি যা সাম্প্রতিক কালে ব্যক্তির চেতনায় দ্রবীভূত হয়েছে এবং যেটা যৌথ-আতঙ্ক পরিস্থিতির একটা আসল জরুরতে রূপ নেয়। এই বিষয়টাও বেশ অশান্তিকর এবং যার জন্য এই মহামারি একটা আদর্শ ছুতো তৈরি করে দেয়।

অতএব, নিরাপত্তার বাসনার নামে সরকার কর্তৃক আরোপিত স্বাধীনতার সীমিতকরণ একটা উদ্ভট দুষ্টচক্রে জায়েজ হয়ে যায়। এই বাসনা আবার তৈরি হয়েছে সেই সরকারেরই হাতে যে এটাকে ঠিকঠাক করার জন্য এখন হস্তক্ষেপ করছে।

____________

২৬শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ইংরেজি অনুবাদের হদিস- The state of exception provoked by an unmotivated emergency । অন্যত্র অবশ্য The Invention of an Epidemic (L’invenzione di un’epidemia, এক বৈশ্বিক মহামারীর উদ্ভাবন ) নামে পাওয়া যাবে ইংরেজি অনুবাদেই।

পাদটীকাঃ এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরে জঁ-লুক ন্যান্সি সহ অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় যার সাপেক্ষে পরবর্তীতে ১১ই মার্চ, ২০২০-তে Contagio (Contagion) এবং ১৭ই মার্চ, ২০২০-তে Chiarimenti (Clarifications) নামে আগামবেনের আরও দুটি লেখা প্রকাশিত হয়।

প্রথম প্রকাশঃ ২৫শে মার্চ, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৫শে মার্চ, ২০২০

লিঙ্কঃ shorturl.at/hFLM3

https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%B0/%E0%A6%85%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%B0%E0%A6%A4-%E0%A6%A1%E0%A6%95-%E0%A6%86%E0%A6%A8-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A6%A5-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%9C%E0%A6%93-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A6%AE%E0%A6%AC%E0%A6%A8

--

--

বোধিচিত্ত

বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার প্রয়াস। A South Asian Platform for Interdisciplinary Studies. Based in Dhaka.