উপহার, এবং বিশেষত এটির ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা — মারসেল মস্‌

বোধিচিত্ত
14 min readAug 28, 2021

--

[ মারসেল মস্‌ (Marcel Mauss) প্রখ্যাত ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক। ১৯২৫ সনে তাঁর বিখ্যাত Essai sur le don. Forme et raison de l’échange dans les sociétés archaïques (“An essay on the gift: the form and reason of exchange in archaic societies”) প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪, ১৯৯০ ও ২০১৬ সনে তিন দফায় ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ফরাসি দার্শনিক জর্জ বাতাইয়ের মারফতে দেরিদা, বদ্রিয়ার প্রভৃতি উত্তর-আধুনিক ভাবুকদের যেমন এটি প্রভাবিত করেছে, তেমনি ডেভিড গ্রেয়বার সহ প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানীদের উপরেও এর প্রভাব বিস্তর। ছোট্ট অথচ তীব্রভাবে প্রভাববিস্তারী এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু নিয়ে বোধিচিত্তে ইতিপূর্বে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ডব্লিও. ডি. হাল্‌স (W. D. Halls) অনূদিত নব্বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ থেকে মস্‌-এর এই গ্রন্থটির ভূমিকার অংশটুকু যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন কাজী রবিউল আলম ও রাদিয়া আউয়াল তৃষা। অনুবাদকদ্বয় উভয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান।]

সূচনালিপি/এপিগ্রাফ

স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়ান এড্ডার পুরনো কবিতার একটি থেকে কিছু স্তবক নীচে তুলে ধরছি।[i] এগুলো এই অধ্যয়নের সূচনালিপি হিসেবে কাজ করতে পারে, আমরা এখানে যা বলতে চাচ্ছি এগুলো সে সম্পর্কিত চিন্তা ও বিষয়বস্তুর আবহে পাঠককে দৃঢ়ভাবে নিমজ্জিত করে।[ii]

(৩৯) আমি কখনো এত উদার মানুষ দেখিনি

এবং তিনি তাঁর অতিথিদের আপ্যায়নে এত উদার

যেন ‘প্রতিদান গৃহীত হবে না’,

কোন মানুষই তাই… [বিশেষণটি এখানে অনুপস্থিত]

তাঁর দ্রব্যের

বিনিময়ে কোন কিছু গ্রহণ করা অসম্মানের ছিল তাঁর

কাছে[iii]

(৪১) অস্ত্র ও পোশাকসহ

বন্ধুরা অবশ্যই একে অপরকে আনন্দ দেয়;

প্রত্যেকেই এটি নিজে থেকেই জানে [তাঁর নিজ অভিজ্ঞতা থেকে]

যারা একে অপরের সাথে উপহার আদান প্রদান করে তাঁরা

দীর্ঘতম সময়ের জন্য বন্ধু থাকেন

যদি সবকিছু সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

(৪২) একজন অবশ্যই বন্ধু হবে

আরেকজন বন্ধুর,

এবং উপহারের বদলে উপহার দিবে;

একজনের অবশ্যই থাকবে

হাসির বদলে হাসি

মিথ্যার বদলে দুঃখ

(৪৪) দেখুন, আপনার যদি একজন বন্ধু থাকে

যার প্রতি আপনার আত্মবিশ্বাস আছে

এবং আপনি যদি ভালো ফলাফল পেতে চান

আপনার আত্মা অবশ্যই তাঁরটার সাথে বিলীন হতে হবে

এবং আপনাকে অবশ্যই উপহার বিনিময় করতে হবে

এবং প্রায়শই তাঁকে দেখতে যেতে হবে।

(৪৪) কিন্তু আপনার অন্যকেউ যদি থাকে

(হুবুহু উদ্ধৃত) যাকে আপনি অবিশ্বাস করেন

এবং আপনি যদি ভালো ফলাফল পেতে চান,

আপনাকে অবশ্যই তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে

কিন্তু আপনার চিন্তা অবশ্যই ভুল হতে হবে

আপনি অবশ্যই মিথ্যা বিলাপ করবেন।

(৪৬) এটিই তাঁর সঙ্গে চলার পথ

যার প্রতি তোমার কোন আস্থা নেই

এবং যার অনুভূতিকে আপনি সন্দেহ করেন,

আপনি অবশ্যই তাঁকে দেখে হাসবেন

এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলুনঃ

বিনিময়ে প্রদত্ত উপহারগুলো অবশ্যই সেরকমই হতে

যেমনটা গ্রহণ করা হয়েছিল।

(৪৭) মহৎ ও সাহসী মানুষেরা

সর্বোৎকৃষ্ট জীবন পায়;

তাদের কোন ভয়ই থাকে না

কিন্তু একজন কাপুরুষ সবকিছুতেই ভয় পায়ঃ

একজন কৃপণ সবসময় উপহারকে ভয় পায়।

ক্যাহেন (Cahen) ১৪৫ নম্বর স্তবকের দিকেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনঃ

(১৪৫)’ ভিক্ষা না চাওয়াই ভালো [কোন কিছু না চাওয়া]

অতিরিক্ত কিছু ত্যাগ করার চেয়ে [ঈশ্বরের প্রতি]:

একটি প্রদত্ত উপহার সবসময় বিনিময়ে আরেকটি প্রত্যাশা করে।

কোন নৈবেদ্য না আনাই ভাল

এটিতে নিয়ে খুব বেশী ব্যয় করার চেয়ে।

কার্যক্রম

বিষয়টি স্পষ্ট। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সভ্যতায় এবং আরো অনেক জায়গায়তেই, উপহারের মাধ্যমেই বিনিময় এবং চুক্তিগুলো সম্পন্ন হয়; তাত্ত্বিকভাবে এগুলো ঐচ্ছিক, বাস্তবে সেগুলো বাধ্যবাধকতামূলকভাবে প্রদান ও পরিশোধ করা হয়।

বর্তমান মনোগ্রাফটি আরও বিস্তৃত অধ্যয়নের একটি একটি অংশ। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত আদিম এবং প্রাচীন হিসেবে চিহ্নিত সমাজগুলোর বিভিন্ন উপগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান চুক্তি সম্বন্ধীয় আইনী সংগঠন ও সর্বাত্মক অর্থনৈতিক পরিসেবা ব্যবস্থা উভয়ের উপর। এটি অনেক ধরনের জটিল বিষয়বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে। এগুলো এমনিতেই অনেক দুর্বোধ্য। আমাদের পূর্ববর্তী সমাজ এমনকি আরো পিছনের ইতিহাসপূর্ব সমাজের যথাযথ সামাজিক জীবন গঠনকারী উপাদানের সবকিছুই এর মধ্যে জড়িয়ে আছে। আমরা এগুলোকে ‘সর্বাত্মক’ সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে অভিহিত করতে চাচ্ছি যার মধ্য দিয়ে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান যুগপৎভাবে অভিব্যক্ত হয়। এগুলো হচ্ছে — রাজনীতি এবং পরিবার উভয়ের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয়, আইনগত এবং নৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ; অনুরূপভাবে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও যা উৎপাদন ও ভোগের বিশেষ ধরন বা অন্যভাবে বললে পরিসেবা ও বিতরণের সামগ্রিক কর্মকান্ডকে সম্পাদন করে। কিন্তু এটি এই ঘটনাসমূহ থেকে উদ্ভূত নান্দনিক প্রত্যয় এবং এই প্রতিষ্ঠান প্রতিভাত প্রত্যয়ের বহিরাবয়বগুলোকে বিবেচনার মধ্যে নেয় না।

এই সব সদা পরিবর্তনশীল জটিল বিষয় এবং বহু ধরনের সামাজিক ‘জিনিস’-এর মধ্যে থেকে আলাদা করে নিবিড়ভাবে শুধু একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে অধ্যয়ন করতে চাচ্ছিঃ যথা, এইসব সর্বাত্মক পরিসেবার ঐচ্ছিক চরিত্র যা আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত ও স্বার্থহীন মনে হলেও আদতে বাধ্যতামূলক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এই ধরনের পরিসেবাগুলো সাধারণত উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। যদিও উপহারগুলো উদারভাবে দেওয়া হয়, এমনকি বিনিময়ের আচরণের ক্ষেত্রে কাল্পনিক নম্রতা, আনুষ্ঠানিকতা এবং সামাজিক কপটতা দেখা যায়, কিন্তু আদপে সেখানে বাধ্যবাধকতা ও অর্থনৈতিক আত্ম-স্বার্থ জড়িত থাকে। যদিও আমরা এই ধরনের প্রয়োজনীয় বিনিময়ের ধরন, তথা, সমাজের শ্রম বিভাজন আবির্ভাব হওয়ার পিছনের নানাবিধ নিয়ম-নীতিগুলো বিশদভাবে উল্লেখ করবোই, তবুও এগুলোর মধ্যে আমরা কেবল একটি বিষয় নিয়ে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করবো। আদিম বা প্রাচীন সমাজের কি ধরনের আইনগত বা স্বার্থের নিয়ম গৃহীত উপহারের আবশ্যিক পরিশোধ করাকে বাধ্য করে। প্রদত্ত বস্তুর মধ্যে এমনকি ক্ষমতা আছে যার কারণে এর গ্রহীতা এর একটি প্রতিদান দেন। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে এই সমস্যাটির প্রতিই দৃষ্টি আবদ্ধ করে এগিয়ে যাব যেখানে অন্যান্যগুলোরও কথা উল্ল্যেখ থাকবে। অনেক ধরনের বিষয়ের যাচাই-বাছাই এর মাধ্যমে আমরা আশা করি এই সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো এবং এ সম্পর্কিত প্রশ্ন নিয়ে একজন কিভাবে অধ্যয়ন শুরু করতে পারে সে পথও নির্দেশ করতে পারবো। এর মধ্য দিয়ে আমরা কোন নতুন ধরনের সমস্যার দিকে ধাবিত হচ্ছি সেটিও দেখবো। এর মধ্যে কিছু আছে চুক্তিভিত্তিক নৈতিকতার স্থায়ী ধরন সম্পর্কিত, যথা কিভাবে বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত আইন আজও ব্যক্তি সম্পর্কিত আইনের সাথে যুক্ত হয়ে আছে তা নিয়ে। অন্যান্যগুলো সেই সব কাঠামো ও চিন্তা নিয়ে কাজ করে যা অন্তত আংশিকভাবে হলেও সবসময় বিনিময়ের কাজের উপর অধিষ্ঠান করেছে এবং এমনকি এখনো পর্যন্ত আংশিকভাবে হলেও যা ব্যক্তি-স্বার্থের ধারণাকে পরিপূরক করে।

আমরা এইভাবে দুটো উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবো। একদিকে, আমরা আমাদের চারপাশের অথবা ঠিক পূর্ববর্তী সমাজের মানুষের বিনিময়ের প্রকৃতি নিয়ে একধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক সদৃশ উপসংহারে পৌঁছাতে পারবো। আমরা সেই সব সমাজের বিনিময় ও চুক্তির প্রত্যয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। দাবী করা হয় এইসব সমাজে অর্থনেতিক বাজার অনুপস্থিত। কিন্তু এটি সত্য নয় — কারণ আমাদের দৃষ্টিতে বাজার একটি মানব প্রত্যয় যা জ্ঞাত কোন সমাজের কাছে অপরিচিত নয় — কিন্তু এই সব সমাজের বিনিময় ব্যবস্থা আমাদের থেকে ভিন্ন। আমরা দেখব যে এই সব সমাজে বণিক ও তাদের প্রধান উদ্ভাবন মুদ্রা আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই বাজারের অস্তিত্ব ছিল। আমরা দেখব আধুনিক (হেলিনিক, হেলেনিস্টিক এবং রোমান) ধরনের চুক্তি ও ক্রয়-বিক্রয় এবং ছাপাঙ্কিত ও খোদাই করা মুদ্রা প্রচলিত হওয়ার পূর্বেও সেগুলো কিভাবে করতো। আমরা এই ধরনের লেনদেনে সক্রিয় নৈতিকতা ও সংঘটনগুলোকে দেখবো।

আমরা দেখবো যে এইসব নৈতিকতা ও সংগঠন অপরিবর্তনীয়রূপে এবং অনেকটা অলক্ষ্যে এখনো আমাদের সমাজে ক্রিয়াশীল। আমরা এটাও মনে করি যে এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ গঠনের মানবিক ভিত্তির একটিকে খুঁজে পাব এবং আমাদের নিজস্ব আইন ও অর্থনৈতিক সংগঠনের সংকট আমাদের সামনে যে ধরনের সমস্যা উত্থিত করে সে সম্পর্কে কিছু নৈতিক সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে সক্ষম হব। আর সেখানে এসে আমরা আপাতত থামব। সামাজিক ইতিহাস, তাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞান, এবং নৈতিকতা, রাজনীতি ও অর্থনীতি চর্চার উপসংহার সম্পর্কিত এই পৃষ্ঠাগুলো আদতে আমাদেরকে পুনরায় সেই পুরানো কিন্তু চির-নতুন প্রশ্নগুলোকে ভিন্ন আঙ্গিকে উত্থাপিত করতে চালিত করে।[iv]

পদ্ধতি:

আমরা এখানে যথাযথভাবে তুলনা পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। সচরাচর যেমনটা করা হয়ে থাকে, সেই অনুযায়ী প্রথমে আমরা আমাদের গবেষিত জনগোষ্ঠীকে শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট নির্বাচিত এলাকার সঙ্গে তুলনা করে অধ্যয়ন করেছি। এগুলো ছিল পলিনেশিয়া, মেলানেশিয়া, আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম এবং বড় ধরনের আইনি কাঠামো সম্বলিত এলাকা । আর যেহেতু এখানে আমরা শব্দ ও এর অর্থ নিয়ে কাজ করেছিলাম সেকারণে এর পরেই স্বাভাবিকভাবেই কেবল সেইসব আইনী ব্যবস্থাগুলোকে বেছে নিয়েছিলাম যেগুলোর নথিপত্র এবং শব্দতাত্ত্বিক অধ্যয়নের মাধ্যমে যেন ঐ সমাজের নিজস্ব চেতনার উপলব্ধিতে প্রবেশ করতে পারি। এটিও আমাদের তুলনার পরিসরকে সীমিত রেখেছিল। পরিশেষে, আমাদের গবেষণা ফোকাস করা ব্যবস্থার প্রতিটিকে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। এভাবে আমরা সেই অবিচ্ছিন্ন তুলনার পদ্ধতি পরিহার করেছি যেখানে সবকিছু একত্রে মিশ্রিত থাকে, এবং যেখানে প্রতিষ্ঠান ও নথিপত্রগুলো তাদের সবধরনের স্থানিক বর্ণ ও গন্ধগুলো হারিয়ে ফেলে।[v]

সর্বাত্মক পরিসেবার তর্জমা

উপহার এবং পোটল্যাচ (potlatch)

এই কাজটি চুক্তির প্রাচীন ধরন নিয়ে ডেভি (Davy) ও আমার দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটি ধারাবাহিক গবেষণারই অংশ।[vi] এগুলোর একটি সারসংক্ষেপ দেওয়া প্রয়োজন।

আমাদের নিকট অতীত সময়কালের সমাজগুলোতে, বা যাদেরকে আমরা অদ্ভুতভাবে আদিম বা নিকৃষ্ট সমাজ বলে থাকি সেখানে বাহ্যত কখনই ‘প্রাকৃতিক’ অর্থনীতি বলতে যা বুঝি সেরকম কোন কিছুই কখনো ছিল না।[vii] এমনকি একটি অদ্ভুত কিন্তু ধ্রুপদি ভুলের মাধ্যমে এই ধরনের সমাজকে চিহ্নিত করবার জন্য পলিনেশিয়ানদের বিনিময় ও বার্টার নিয়ে কুক (Cook)-এর লেখাকেও বেছে নেওয়া হয়েছিল ।[viii] এখন, সেই একই পলিনেশীয়দেরকেই আমরা এখানে অধ্যয়ন করতে চাচ্ছি। আইন ও অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা থেকে তাঁরা কতটা দূরে সেটিই আমরা এখানে দেখবো।

আমাদের পূর্ববর্তী এই অর্থনীতি এবং আইনি ব্যবস্থায় কেউ দ্রব্য, সম্পদ ও পণ্যের এমন কোন বিনিময়ও খুঁজে পাবে না, যা শুধু ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির আদান-প্রদানের মাধ্যমে দিয়ে সম্পাদিত হয়। প্রথমত, এখানে ব্যক্তি নয়, বরং গোষ্ঠী একে অপরের উপর বিনিময় ও চুক্তির বাধ্যবাধকতা আরোপ করে।[ix] এখানে চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো হচ্ছে গোত্র, ট্রাইব এবং পরিবারের মতো বৈধ সত্তা, যারা গোষ্ঠী হিসেবে নিজেরা বা দলপতির মাধ্যমে অথবা উভয় পথেই একটি স্থানে একে অপরের মুখোমুখি হয়।[x] উপরন্তু তারা কেবল জমি-জমা, স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি এবং অর্থনৈতিকভাবে দরকারী জিনিসের বিনিময় করতো তা নয়। বরং এখানে ভোজ, আচার-অনুষ্ঠান, সামরিক পরিসেবা, নারী, শিশু, নাচ, উৎসব এবং মেলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আসলে শিষ্ঠতার বিনিময় হতো। আর সমগ্র বিষয়টিতে অর্থনৈতিক লেনদেন একটি উপাদান ছিল কেবল। একইভাবে এর মধ্য দিয়ে যে বিস্তৃত ও স্থায়ী চুক্তি সম্পাদিত হতো সেখানে সম্পদের হাত বদল একটি দিক ছিল কেবলমাত্র। পরিশেষে, যদিও এই ধরনের সর্বাত্মক পরিসেবা ও পাল্টা-পরিসেবাগুলো অনেকটা উপঢৌকন ও উপহারের মধ্য দিয়ে ঐচ্ছিকভাবে সম্পাদিত হতো, কিন্তু শেষ বিচারে সেগুলো খুবই বাধ্যতামূলক এবং ব্যক্তিগত বা জনযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনুমোদিত হতো। আর এটিকেই আমরা“সর্বাত্মক পরিসেবা ব্যবস্থা (system of total services)”বলতে চাচ্ছি। প্রশান্ত মহাসাগর অথবা উত্তর আমেরিকার ট্রাইবদের দুটো জ্ঞাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক মৈত্রীবন্ধনের মধ্যে সাধারণত এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের খাঁটি বৈশিষ্ট্য দৃশ্যগত হয় বলে আমাদের মনে হয়। এখানে আচার-অনুষ্ঠান, বিবাহ, সম্পদের উত্তরাধিকার, আইনি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক, সেনাবাহিনী ও পুরোহিতদের পদমর্যাদা — এককথায় সবকিছু একটি ট্রাইবের দুই অর্ধাংশের সম্পূরকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সংগঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিশেষত তাদের খেলাগুলো যেমন উভয় পক্ষ দ্বারাই পরিচালিত হয়।[xi]

তি্‌লংগিত ও হাডা নামের উত্তরপশ্চিম আমেরিয়াকার দুটো ট্রাইব যখন বলে যে তারা ‘দুইটি ট্রাইবাল জ্ঞাতিগোষ্ঠী একে অপরের প্রতি সম্মান দেখায়’, তখন তারা এই রীতিগুলোরই জোড়ালো প্রকাশ ঘটায়।[xii]

কিন্তু উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার এই দুইটি ট্রাইবদের মধ্যে এবং পুরো অঞ্চল জুড়েই এরকম ‘সর্বাত্মক পরিসেবার (total services)’ই একটি ধরন দেখতে পাওয়া যায়। যদিও সেগুলো ছিল কদাচিৎ, কিন্তু অত্যন্ত বিকশিত একটি ধরন। আমেরিকার লেখকদের মতো করে আমরা একে ‘পোটল্যাচ’ বলার প্রস্তাব করছি। ভ্যাঙ্কুভার থেকে আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত শ্বেতাঙ্গ ও ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এই চিনুক (chinook) শব্দটি প্রাত্যহিক ভাষার অংশ হয়ে উঠেছে। পোটল্যাচ বলতে মূলত ‘খাওয়া’, ‘ভোজন করা’ বোঝায়।[xiii] এই ট্রাইবগুলো দ্বীপ, অথবা উপকূল, অথবা পাথুরে পর্বতমালা এবং উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে বসবাস করতো। তারা ছিল খুব ধনী। তারা একটা অবিরাম ভোজ, মেলা ও বাজারের উৎসবের মধ্য দিয়ে তাদের শীতকালগুলো অতিবাহিত করতো, যা ট্রাইবদের একটা জাঁকজমকপূর্ণ জমায়তেও তৈরী করতো। ট্রাইবগুলো ভ্রাতৃসংঘ ও গুপ্তসংঘে নিজেদেরকে শ্রেণীবদ্ধভাবে সংগঠিত করতো, যেখানে প্রায় পরেরটাকে আগেরটার সাথে গুলিয়ে ফেলা হতো, যেমনটা গোত্রের ক্ষেত্রে ঘটতো। এখানে [এই সব উপলক্ষগুলিতে] গোত্র, বিবাহ, দীক্ষা, শামানীয় অধ্যাত্ম (shamanist seances) বৈঠক, এবং গোত্রের ঈশ্বর, টোটেম বা সামষ্টিক কিংবা ব্যক্তিগত পূর্বপুরুষকে উপাসনা করার সভা — সবকিছুই আচার-অনুষ্ঠান এবং আইনি ও অর্থনৈতিক সর্বাত্মক পরিসেবার একটি জটিল জালে আবদ্ধ ছিল যার মাধ্যমে সমাজে, ট্রাইবে, এবং ট্রাইবদের সংঘ, এবং এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরে মানুষের রাজনৈতিক পদমর্যাদা নির্ধারণের বিষয়টি নিস্পত্তি হতো।[xiv] তথাপি এই সব ট্রাইবদের সম্পর্কে লক্ষণীয় বিষয় হলো তাদের এই ধরনের সকল ক্রিয়াকলাপে দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার নীতির উপস্থিতি। তারা বিরোধীপক্ষের নেতা ও সম্মানীয় ব্যক্তিদের সাথে লড়াই ও হত্যা করতে পর্যন্ত উদ্যত হয়। উপরন্ত, প্রতিপক্ষ নেতা ও তার সহযোগীদের (সাধারণত পিতামহ, শ্বশুর, বা জামাই) দমন করার উদ্দেশ্যে তারা যে সম্পদ আহরণ করে সেটাকেও চূড়ান্ত বিনষ্ট করা থেকে পিছপা হয় না।[xv] এখানে একটি পুরো গোত্রের সব সদস্য, মালিকানাধীন সমস্ত কিছু এবং সমস্ত কৃতকর্মের পক্ষ থেকে তার একজন দলনেতার মধ্যস্থতার মাধ্যমে চুক্তিগুলো করে। সেই কারণে এটি সর্বাত্মক পরিসেবা।[xvi] কিন্তু দলনেতার পক্ষ থেকে এই পরিসেবার কাজটি একটি চরম যন্ত্রনাদায়ক রূপ নেয়। এটি মূলত সুদভিত্তিক ও অপব্যয়ী। এটি নিজেদের মধ্যে পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে লড়াই যেখান থেকে তার গোত্র পরবর্তীতে উপকৃত হতেও পারে।

এই ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বোঝাতে আমরা পোটল্যাচ প্রত্যয়টি ব্যবহার করতে চাচ্ছি। কিন্তু আরো বিস্তৃতভাবে কম ঝুঁকিসহ এবং অধিক নির্ভুলতার সাথে আমরা এটিকে বলতে পারিঃ একটি যন্ত্রণামূলক সর্বাত্মক পরিসেবা (total services of an agonistic type)।

আমরা এখনও অবধি উত্তর-পশ্চিম আমেরিকা,[xvii] মেলানেশিয়া এবং পাপুয়ার[xviii] ট্রাইবদের মধ্যে ছাড়া এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ খুবই কম খুঁজে পেয়েছি। আফ্রিকা, পলিনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং উত্তর আমেরিকা বাদে বাকি সব জায়গায় সর্বাত্মক পরিসেবার প্রাথমিক ধরনকেই গোত্র এবং পরিবারগুলোর মধ্যে বিনিময়ের ভিত্তি বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। তবে, আরো বিস্তারিত গবেষণাগুলো উত্তর-পশ্চিম আমেরিকা, মেলানেশিয়া এবং অন্যান্য স্থানের তীব্র বৈরিতা ও সম্পদ ধ্বংসভিত্তিক বিনিময়ের মধ্যখানে বেশকিছু অন্তর্বর্তী ধরনের সন্ধান পেয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখানে অধিকতর পরিমিত যেখানে চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো তাদের উপহারের মধ্য দিয়ে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। একইভাবে আমরা যেমন কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, ভোজ ও বিবাহ এবং সাধারণ কোন আমন্ত্রণে উপহারের মাধ্যমে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পাল্লা দেই। জার্মানরা যেমন বলে থাকে, আমরা এখনো প্রতিশোধ নেওয়ার (revanchieren) [xix] প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমরা প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় বিশ্ব এবং বিশেষত থ্রেসিয়ানদের মধ্যে এই অন্তর্বর্তী ধরনগুলো খুঁজে পেয়েছি।[xx]

প্রথা ও চিন্তার বিভিন্ন প্রসঙ্গ এই ধরনের আইন ও অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই ধরনের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে স্পষ্টভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেটিই যা একজন ব্যক্তিকে গৃহিত উপহারের প্রতিদান দিতে তাঁকে বাধ্য করে। পলিনেশিয়া ছাড়া অন্য কোথাও এই ধরনের বাধ্যবাধকতার নৈতিক ও ধর্মীয় হেতু স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়না। এই বিষয়টিকে আরো বিস্তারিতভাবে অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাবো যেকোন ধরনের ক্ষমতা ব্যক্তিকে প্রাপ্ত জিনিসের প্রতিদান দিতে এবং সচরাচর এই ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে তাড়িত করে।

____________

দোহাই

[i] ক্যাসেল (Cassel) তাঁর থিউরি অব স্যোসাল ইকোনোমি (Theory of Social Economy) গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৩৪৫ পৃষ্ঠায় এই ধরণের টেক্সট সম্পর্কে ধারণা দেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পন্ডিতরা তাদের মানুষদের এই সব প্রাচীন ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পরিচিত ছিলেন।

[ii] মরিস ক্যাহেন (Maurice Cahen) অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য এই অনুবাদটি করে দিতে সম্মত হয়েছিলেন।

[iii] চার নম্বর লাইনে বিশেষণের অনুপস্থিতির কারণে এখানে স্তবকের অর্থটা অস্পষ্ট। কিন্তু মূল ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন কেউ স্বাভাবিকভাবে ‘’উদার”, বা “অমৃতব্যয়ী” অর্থসম্বলিত শব্দ বসিয়ে দেয়। ৩ নম্বর লাইনটাও কঠিন। ক্যাসেল এটাকে অনুবাদ করেছেনঃ “যাকে দেওয়া হয় সেটা যখন সে গ্রহণ করে না।“ এর বিপরীতে ক্যাহেনের অনুবাদটা আক্ষরিক। সে আমাদেরকে লেখেঃ এর প্রকাশটা অস্পষ্ট। কেউ এর অর্থ বোঝায়ঃ “কোন কিছু গ্রহণ করা তাঁর কাছে আনন্দদায়ক কোন কিছু না।“ অন্যরা এটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেঃ “কোনও উপহার গ্রহণ করা তার প্রতিদান দেওয়ার বাধ্যবাধকতা বহন করে না”। স্বাভাবিকভাবেই আমি দ্বিতীয় ব্যাখ্যার দিকে ঝুঁকেছি। পুরানো স্ক্যাণ্ডিনেভীয় ভাষায় আমাদের দক্ষতার ঘাটতি সত্ত্বেও, আমরা আরেকটি ব্যখ্যা দেওয়ার সাহস করেছি। স্পষ্টতই এর প্রকাশটা একটি পুরানো সাহিত্য উক্তির সাথে মেলে যার অর্থ ‘গ্রহণের জন্য গৃহীত হয়েছিল’ এর মতো। এটা যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে লাইনটি মেহমান ও মেজবান উভয়ের মনের অবস্থাকে বোঝায়। প্রত্যেকেই এমনভাবে তাদের আতিথেয়তা, বা উপহারকে পেশ করতো যেন সেটার কখনই কোন প্রতিদান হয় না। কিন্তু, তা সত্ত্বেও প্রত্যেকেই মেহমানের উপহার বা এর বিনিময়ে মেজবানের প্রদত্ত সমস্ত উপহার এবং সেবাকে গ্রহণ করতো, কারণ সেগুলো ছিল সম্পত্তি এবং উপরন্তু সেগুলো ছিল তাদের চুক্তিটি জোরদার করবার একটি মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে তাঁরা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ গঠন করে।

আমাদের কাছে এমনকি এটাও মনে হয়েছে যে এই স্তবকগুলোর আরো অনেক পুরানো সংস্করণ চিহ্নিত করা যায়। প্রত্যেকের কাঠামোটা একই, কৌতূহলী কিন্তু স্পষ্ট। প্রত্যেকটিতে একটি বিচারসংক্রান্ত উক্তি কেন্দ্র গঠন করেঃ ‘প্রতিদান গৃহীত হবেনা’ (স্তবক ৩৯), ‘যারা উপহার বিনিময় করে তাঁরা বন্ধু’ (৪১), ‘উপহারের বিনিময়ে উপহার দিতে হয়’ (৪২), ‘আপনার আত্মা অবশ্যই তাঁর সাথে মিশ্রিত করুন এবং আপনি অবশ্যই উপহার বিনিময় করুন’ (৪৮), ‘একটা প্রদত্ত উপহার সর্বাদাই বিনিময়ে আরেকটি উপহার আশা করে’ (১৪৫) প্রভৃতি। এটি উক্তিগুলোর একটি মূল্যবান সংগ্রহ। এই প্রবাদ, বা বিধি, ভাষ্যের অলঙ্কার হিসেবে এর সাথে যুক্ত থাকে। ফলে এখানে আমরা শুধু প্রাচীন আইনকেই শুধু পাই না, উপরন্তু একটি অতি প্রাচীন সাহিত্যকেও পাই।

[iv] আমি বুর্কার্ডের (Burckhard) সাথে পরামর্শ করতে পারিনি, Zum Begriff der Schenkung, p. 53 ff. কিন্তু, অ্যাংলো-স্যাকসন আইন নিয়ে আমরা যে বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চেয়েছিলাম তা খুবই স্পষ্টভাবে পোলক (Pollock) ও মাইটল্যান্ড (Maitland) কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে, History of English Law, vol. 2, p. 892: ‘বিস্তৃত শব্দ “উপহার”, বিক্রয়, বিনিময়, বন্ধক্‌ এবং ইজারাকে অন্তর্ভুক্ত করে।‘ Cf. ibid, p. 12, ibid, pp. 212–14: এমন কোন মুক্ত উপহার নেই যা আইনের প্রভাব দ্বারা পরিচালিত।‘ এ সম্পর্কে নুবেকারের (Neubecker, ১৯০৯) জার্মানির যৌতুক নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধটিও দেখুন, Die Mitgift, p. 65 ff.

[v] এই মন্তব্যগুলো কেবল বিশেষজ্ঞদের জন্য জরুরী।

[vi] [ডেভি] G. Davy (১৯২২) ‘Foi jurée’, Travaux de l’Année Sociologique; for bibliographical information see: M. Mauss (মস্‌, ১৯২১) ‘Une forme archaïque de contrat chez les Thraces’, Revue des etudes grecques; R.Lenoir (1924) ‘L’Institution du Potlach’, Revue Philosophique.

[vii] M.F.Sondo (1909) Der Güterverkehr in der Urgesellschaft (Institut Solvay), এ বিষয়ের একটি ভালো আলোচনা করেছেন এবং একটি সূত্র (পৃঃ ১৫৬) অনুসরণ করা শুরু করেছিলেন যেটি আমরাও অনুসরণ করবো।

[viii] গ্রিয়ারসন (১৯০৩) এর Silent Trade, ইতিমধ্যে আমাদেরকে এই ধরনের ভুলবোঝা থেকে মুক্ত হবার প্রয়োজনীয় যুক্তি দিয়েছে। একই কাজ করেছেন von Moszkowski (১৯১১) তাঁর Vom Wirtschaftsleben der primitiven Völker গ্রন্থে। যদিও চুরিকে তিনি একটি আদিম প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত কোন কিছু নেওয়ার অধিকারের সাথে চুরিকে গুলিয়ে ফেলেন। এ বিষয়ের উপর মাওরিদের (Maoris) নিয়ে ভালো একটি বর্ণনা পাওয়া যাবে W. von Brun [sic] (1912) Wirtschaftsorganisation der Maori (Lamprecht’s contribution, পৃ. ১৮), Leipzig গ্রন্থে, যেখানে বিনিময় নিয়ে একটি অধ্যায়ই রয়েছে। তথাকথিত আদিম মানুষের অর্থনীতি নিয়ে কাজের সবচেয়ে সাম্প্রতিক সারাংশ পাওয়া যাবেঃ কুপার্‌স (Koppers, ১৯১৫-১৬)-এর ‘Ethnologische Wirtschaftsord-nung’, Anthropos, পৃ. ৬১১-৫১, ৯৭১-১০৭৯। এটি সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবিত মতবাদগুলোর ব্যাখ্যা হিসেবে ভালো, অন্যথায় কিছুটা দ্বান্দ্বিক।

[ix] আমাদের সাম্প্রতিক প্রকাশনাগুলোতে আমরা দেখেছি যে অস্ট্রেলিয়ায় ট্রাইবদের মধ্যেও, বিশেষ করে তাদের মৃত্যুর আনুষ্ঠানিকতাকে কেন্দ্র করে সীমিত পরিসরেও হলেও ‘সর্বাত্মক পরিসেবা’ শুরু হচ্ছে। উপরন্ত এটি এখন আর শুধু গোত্র এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। উত্তর অঞ্চলের কাকাডুদের (Kakado) মধ্যে দ্বিতীয় সমাধিকে অনুসরণ করে তৃতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠানের মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে একধরনের একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠিত হয় আক্ষরিক অর্থে হলেও এটা জানার জন্য কার যাদুবিদ্যার মাধ্যমে এই মৃত্যু সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু অষ্ট্রেলিয়ীয় ট্রাইবদের মধ্যে বিদ্যমান স্বাভাবিক প্রথার বিপরীতে এর মাধ্যমে কোন জাতিবৈরিতা সৃষ্টি হয় না। মানুষেরা তাদের বর্শা সংগ্রহ এবং বিনিময়ে হিসেবে কি চাওয়া যেতে পারে তা নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরেরদিন অন্য একটা ট্রাইব — উদাহরণস্বরূপ উমোরিউ (Umoriu) — তাদের শিবিরে বর্শাগুলো নিয়ে যায়, যারা তাদেরকে এই শিবিরে পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে যথার্থ বুঝতে পারে। সেখানে বর্শাগুলো এর মালিকানা অনুযায়ী স্তুপাকারে রাখা হয়। এবং চাহিদাকৃত দ্রব্যগুলো এই স্তুপগুলোর বিপরীতে রাখা হয় আগে থেকে জ্ঞাত একটি শুল্ক তালিকা অনুযায়ী। এরপর কাকাডু সেগুলোর সবকিছু নিয়ে যায় (Baldwin Spencer, Tribes of the Northern Territory, ১৯১৪, পৃ. ২৪৭). স্যার বল্ডউইন উল্লেখ করেন যে, এই বস্তুগুলো বর্শার বিপরীতে পুনরায় বিনিময় হতে পারে, যে বিষয়টি আমাদের কাছে পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। পক্ষান্তরে, এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান এবং বিনিময়ের মধ্যে তিনি তেমন কোন যোগসুত্র খুঁজে পাননি এবং পাশাপাশি তিনি এটাও বলেন যে স্থানীয়রাও এ ধরনের কোন সম্পর্ক দেখেনি। এতদসত্ত্বেও, প্রথাটি যথার্থ অনুধাবনযোগ্যঃ এটা অনেকটা কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে একটা আইনি নিস্পত্তিতে পৌঁছানো। যেটি ছিল জাতিবৈরিতাকে সরিয়ে একটি আন্তঃট্রাইব বাজারের সুত্রপাত। দ্রব্যের বিনিময়ের সাথে সাথে এই ধরনের শোকে একই সঙ্গে শান্তি ও সংঘতির প্রতিশ্রুতিরও বিনিময় ঘটে। অষ্ট্রেলিয়াতে এটি সাধারণত গোত্র ও পরিবারের মধ্যে ঘটত, যারা কোন না কোনভাবে বিবাহের মাধ্যমে সংযুক্ত ও সম্পর্কিত থাকত। এখানে পার্থক্য শুধু এইযে প্রথাটি এখন ট্রাইবদের মধ্যেও বিস্তৃত হয়েছে।

[x] কিন্তু পিন্দারের (Pindar) মত উত্তর-ধ্রুপদী (late-classical) কবি তাঁর অলিম্পিক, ৮, ৪-এ ধরনের কথা বলেছেন। পুরো অনুচ্ছেদটি এখনো আইনি পরিস্থিতিকে ঘিরে আবদ্ধ যেটি নিয়ে আমরা পরে বলব। উপহার, সম্পদ, বিবাহ, সম্মান, অনুগ্রহ, মিত্রতা, যৌথ ভোজ এবং পবিত্র পানীয়, এমনকি বিবাহ উদ্ভুত ঈর্ষা- এর মতো সব প্রসঙ্গগুলোই অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যা আলোচনার দাবি রাখে।

[xi] বিশেষভাবে ওমাহা’দের (Omaha) বল খেলার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিয়মগুলো দেখুনঃ Alice Fletcher ও La Flesche (১৯০৫-৬) ‘Omaha Tribe’, Annual Report of the Bureau of American Anthropology 27:197, 366.

[xii] ক্রাউস (Krause), Tlinkit Indianer, p. 234 ff., যে উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা সেখানে এই বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করেন, যদিও তখন তিনি এদেরকে পোটল্যাচ বলেন নি। বরসিন (Boursin) তাঁর Porter (১৯০০) ‘Report on the Population…of Alaska’, in Eleventh Census, pp. 54–66 তে, এবং পোর্টারও (ibid, p. 33), এই ধরনের পারস্পরিক প্রশংসার বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান এবং এইবারে সেটাকে পোটল্যাচ নাম দেওয়া হয়। কিন্তু সোয়ান্টানই (Swanton, ১৯০৫) ‘Social Conditions of the Tlingit Indians’, Annual Report of the Bureau of American Ethnography, 26:345, etc. তে এবিষয়ে সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। Année Sociologique 11:207 এবং G.Davey (১৯২২) ‘Foi jurée’, p. 172. -তে এই বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণগুলো দেখুন।

[xiii] পোটল্যাচ শব্দের অর্থের জন্য ব্যারবাউ (Barbeau, ১৯১১) Bulletin de la Société de Géographie de Québec এবং ডেভি (Davey), পৃ. ১৬২ দেখুন। কিন্তু, প্রচারিত অর্থটি আমাদের কাছে মুল অর্থ মনে হয়নি। এটি সত্য যে বোয়াস (Boas) মূলত পোটল্যাচ শব্দটি চিনুক নয়, বরং কোয়াকিউট্‌ল (Kwakiutl) ভাষায় দিয়েছেন। তিনি Kwakiutl Texts, second series, Jesup [sic] Expedition, vol. 10, p. 43, n. 2; এবং ibid, vol. 3, pp. 255, 517 এ PoL শিরোনামের অধীনে কোয়াকিউট্‌ল ভাষায় পোটল্যাচ বলতে ‘প্রতিপালক’, এবং আক্ষরিক অর্থে ‘তৃপ্তির স্থান’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু পোটল্যাচের দুটি অর্থ, যেমন ‘উপহার’ এবং ‘খাদ্য’ এখানে আলাদা নয়। কারণ এখানে ‘সর্বাত্মক পরিসেবা’র আবশ্যিক ধরনটি তাত্ত্বিকভাবে হলেও পুষ্টির সাথে সম্পর্কিত। এই অর্থের জন্য দেখুন Ch. 2, n. 209 (p. 122).

[xiv] অ্যাডাম ১৯১১ সাল ও পরবর্তী সময়গুলোতে তাঁর প্রবন্ধ Zeitschrift für vergleichender Rechtswissenschaft –তে, এবং সেলার (Seler, ১৯২০) the Festscrift , পাশাপাশি ডেভি (১৯২২) তাঁর ‘Foi jurée’ -তে পোটল্যাচের আইনি দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দিকও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সামানভাবে বিস্তারিত অধ্যয়ন করা উচিৎ। জড়িত ব্যক্তিদের ধর্মীয় প্রকৃতি এবং বিনিময় ও বিনষ্ট করা দ্রব্যও বস্তুত চুক্তির প্রকৃতির সাথে অপ্রাসঙ্গিক নয়। এদের উপর আরোপিত গুরুত্বও কম নয়।

[xv] হাইডা (The Haïda) এটাকে ‘সম্পদ’ হত্যা বলেছেন।

[xvi] এ সম্পর্কে বোয়াস এর ‘Ethnology of the Kwakiutl’, Annual Report of the Bureau of American Ethnography, 35, 2:1340 -এ হান্টের নথিগুলো দেখুন। এখানে কিভাবে একটি গোত্র পোটল্যাচে তার অবদানকে দলনেতার কছে নিয়ে আসে সেটির একটি চমৎকার বর্ণনা এবং কিছু খুবই চমকপদ কথোপকথন পাওয়া যায়। বিশেষত, দলনেতা বলেন, ‘এটি আমার নামে হবে না। এটি আপনার নামে হবে এবং আপনি ট্রাইবদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে৮ যাবেন যখন বলা হবে যে একটি পোটল্যাচের জন্য আপনি আপনার সম্পত্তি দিচ্ছেন।‘ (p. 1372, line 34 ff.)

[xvii] বাস্তবে পোটল্যাচের কার্যক্ষেত্র উত্তর-পশ্চিম ট্রাইবদের সীমা ছাড়িয়েও প্রসারিত। বিশেষত, আলাস্কার এস্কিমোদের ‘অনুরোধ উৎসব (asking festival)’ প্রতিবেশী ইন্ডিয়ান ট্রাইবদের কাছে থেকে ধার বা ঋণ নেওয়ার চেয়েও বেশী কিছু ছিল কিনা সে বিষয়টি একজনকে অবশ্যই বিবেচনা করা উচিৎ। দেখুন See Ch. 1, n. 45, p. 93.

[xviii] Année Sociologique 11:101; 12:372–4, and Anthropologie (1920) (report of the sessions of the Institut Français d’Anthropologie)’তে আমাদের মন্তব্য দেখুন। লেনোয়ার (Lenoir, ১৯২৪) দক্ষিণ আমেরিকাতে দুটি মোটামুটি স্পষ্ট পোটল্যাচ কেসের কথা উল্লেখ করেছেন (‘Expéditions maritimes en Mélanesie’, Anthropologie, September.)

[xix] এম.থুর্নওয়াল্ড (Thurnwald1912) Forschungen auf den SalomoInseln vol. 3, p. 8. এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

[xx] মারসেল. মস্‌ (১৯২১) Revue des études grecques, vol. 34.

প্রকাশঃ ২৪শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮:::৭ই জুন, ২০২১

Link: https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%A6/%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%B9%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%AC-%E0%A6%AC%E0%A6%B6%E0%A6%B7%E0%A6%A4-%E0%A6%8F%E0%A6%9F%E0%A6%B0-%E0%A6%AB%E0%A6%B0%E0%A6%A4-%E0%A6%A6%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%A7%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%A7%E0%A6%95%E0%A6%A4-%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%B2-%E0%A6%AE%E0%A6%B8

--

--

বোধিচিত্ত

বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার প্রয়াস। A South Asian Platform for Interdisciplinary Studies. Based in Dhaka.