জেগে উঠেছি এক অবরুদ্ধ সকালে — আন্তোনি ভ্রাদিস

বোধিচিত্ত
4 min readAug 28, 2021

--

[ আন্তোনি ভ্রাদিস (Antonis Vradis) যুক্তরাজ্যের লাফব্রাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের লেকচারার। ভূগোল, সামাজিক বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক দর্শন তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু। তিনি রাজনৈতিক ভূগোলের (Political Geography) সহযোগী সম্পাদক ওনগরের (City) সিনিয়র সম্পাদক। করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে তাঁর This morning, I woke up in a curfew শিরোনামের লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]

ইতিহাস ভেঙে পড়ে: ধীরে বয়ে যাওয়া কলমের ঘন কালির ন্যায় সময় আরও দ্রুততম ও ক্ষিপ্র কোন জন্তুর ন্যায় অদ্ভুত এক রুপ ধারণ করে — এ এক ভয়ানক সময়, দাবী করে আপনার মনোযোগ; আপনাকে ছিনিয়ে আনে ঐ সকল ছোটখাটো এবং পরবর্তীতে তুচ্ছ মনে হওয়া এমন ব্যাপার থেকে যা পূর্বে (previously) আপনাকে ব্যতিব্যস্ত (preoccupied) রেখেছিল occupied রেখেছিল[i]; অথচ এসব ব্যাপারে একসময় আপনার মনোভাব ছিল, ‘ওহ, এতো বড় জরুরী কাজ!’ ‘পূর্বে’ এবং ‘ব্যতিব্যস্ত’ শব্দ দুইটি অদ্ভুত। এটা ঠিক সেই বিস্ফোরক মুহুর্ত যার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব এবং পূর্বাপর ঘটনার সাহায্যে সংজ্ঞায়িত করা জরুরী। অন্যভাবে বলতে গেলে, সবকিছুর বিন্যাসের ব্যাপারটাও সংজ্ঞায়িত করা জরুরী। দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে আজ এটাই প্রমানিত, এমন এক ভগ্ন ইতিহাসের মাঝেই আমাদের বসবাস। এই কোডিভ-১৯ মুহুর্তে (এই নামেই হয়তো তাকে ডাকা যায়) ২০২০ সালের ২৩শে মার্চের গ্রীক রাস্ট্রসীমার মাঝে সম্পূর্ণ–মানে সম্পূর্ণভাবেই কারফিউ জারি করা অবরুদ্ধ এক সকালে জেগে উঠেছি। এ এমন এক কারফিউ যা বাম, ডান ঘরানার সকল রাজনীতিবিদ একবাক্যে মেনে নিয়েছে এবং প্রশংসা করেছে। আমাদের বলা হচ্ছে, যদি দেশ বাঁচাতে হয় এবং অদৃশ্য কিন্তু অস্তিত্বশীল হুমকির এই ত্রাসকে জয় করতে হয়, তবে এই মুহুর্তে এটাই জরুরী।

ইতোমধ্যে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের মাঝে এক অদ্ভুত সহনশীলতা গড়ে তুলেছে — তা সে ব্যতিক্রমী এবং জরুরী কোনো ব্যাপারে হোক, জোরপূর্বক কিছু ঠেসে দেয়ার ব্যাপারে হোক, কিংবা আমাদের প্রাত্যহিকভাবে নির্মাণ, পুননির্মাণ করা সংক্রান্ত কোন আদেশ জারির ব্যাপারে হোক। সত্যি বলতে কি, আমাদের স্বাভাবিক এখন গঠিত হয়েছে ব্যতিক্রম মারফত। তারপরেও উঠে আসে কন্ঠস্বর — এক নতুন কন্ঠস্বর যা হয়তো অজানার আকার-আকৃতির ভয়ে কম্পিত, হয়তো সমস্বরে বলতে চায়, এই হয়তো “সেই”। সমাপ্তি। কিন্তু কিসের সমাপ্তি? তারই কি সমাপ্তি যা হয়তো এতদিন আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি? পশ্চিমা সভ্যতার সমাপ্তি? সামাজিক চুক্তির সমাপ্তি (যা বারবারই সম্পাদন, পুনঃসম্পাদন ও ভাঙা হয়েছে)? এটাই কি সেই ‘শেষ’ হতে চলা?

হ্যাঁ, সবই হয়তো নির্মম সত্য। সবকিছুরই হয়তো ভয়ানক পরিসমাপ্তি হবে। এও জেনে নিলাম, এটি সামাজিক বৈরিতারও অবসান বটে। ভার্চুয়াল ভিড়ের আর্তচিৎকারে আজ ডুবে গেছে অনেক ‘আমি’। সেই অনেক ‘আমি’রই আবার আবেদন, যেকোন মূল্যেই হোক, সম্মিলিত এই ‘আমাদের’ দিকে ধেয়ে আসা হুমকি ঠেকাতে হবে। কিন্তু, এই সম্মিলিত ‘আমরা’ বহু আগেই এই ব্যাক্তি ‘আমি’র চাপে ফুঁটো হয়ে গেছে। আবার এ কথা বলেও পার পাওয়া যাবে না যে, ইতিহাস পরিহাস করতে জানে না। বলুন, ভাইরাস সম্পর্কে যা যা বলা যায় এবং এটার জন্মস্থান সম্পর্কিত আপনার পুর্বধারণার সাথে মিলে যাওয়া যেকোন তথ্য-উপাত্ত পড়ুন; একটা ব্যাপারে কিন্তু আমরা সবাই একমত যে, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য এর চাইতে উপযুক্ত সময় আর হতে পারত না।

প্রথমত, এটি আঘাত হানে ২০২০ সনে। যেকারো জন্য এ এক যন্ত্রনাদায়ক শিক্ষা, বিশেষ করে যারা সাই-ফাইবোদ্ধাদের কদর করেননি। দ্বিতীয়ত, এর আবির্ভাব হয়েছে এক বিচ্ছিন্ন সময়ের বাঁকে, যখন এই ‘আমি’র দল নিজেরাই নিজেদের ইচ্ছায় এক সম্মিলিত জম্বি শরীর টেনে হিঁচড়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাভাবিকতা তত্ত্বের এই ধর্মগুরুরাই এখন চায়, এই সমস্ত ব্যাক্তি ‘আমি’রা এক কাতারে দাঁড়াবে যাতে ‘আমাদের’ নামক জম্বিসত্তাকে বাঁচানো যায়; অথচ কি পরিহাস! এরাই এক সময় অক্লান্তভাবে পিঠচাপড়ে প্রশংসা করে গেছে সেই ব্যক্তিসত্ত্বাবাদী ‘আমি’কে। তৃতীয়ত, এটি এমন এক সময়ে আঘাত করেছে, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চোরাস্রোত এতই শক্তিশালী যে,চাইলেই এর ভেতর থেকেই এটি’ সত্য, আধা-কাঁচামিথ্যা, পরিমিত এবং পাগল হয়ে যাওয়ার মত প্রতিক্রিয়ার জগাখিচুরি বানিয়ে দিতে পারে, এই চোরাস্রোত আপনাকে আলোচনায় ভাসিয়ে দিতে পারে, এবং পরবর্তীতে প্রায় অর্থহীন কি ঘটনা ঘটতে চলেছে তারও সারসংক্ষেপ আপনার সামনে হাজির করতে পারে। চাঁছাছোলাভাবে বলতে গেলে, এই সময়ে এই ভাইরাসই উপযুক্ত। অভাবনীয় এর ক্ষমতা, এটি গত সপ্তাহেই দেখিয়ে দিয়েছে যে ধারাবাহিক শৃঙ্খল, আদেশ, প্রজ্ঞাপন, সিদ্ধান্ত ও আচরণবিধি কি জিনিস! এথেন্সেই সর্বাত্মক কারফিউ? ২০২০ সালে? অসম্ভবই মনে হয়।

সেই অসম্ভবই ঘটছে এখন। আজ সকালে, এই কারফিউর শহরেই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেছি। ভাববেন না আমি বব মার্লের গানে । ভাববেন না আমি বব মার্লের গানে [ii] বুদ হয়েছিলাম। এক্সারসিয়া শহরের কেন্দ্রেই ছিলাম আমি: চারপাশে শূন্য দালান, নীরব রাস্তা, মাঝে মাঝে মাথার উপর হেলিকপ্টারের শব্দ আর নিয়ম ভেঙে কিছু মানুষের এদিক-সেদিক ঘোরাফেরার অদ্ভুত দৃশ্য। কারফিউর কয়েক ঘন্টা বা দিন আগে রাজধানী হতে পালিয়ে যাওয়া কিছু মানুষ ব্যতিত আমাকে ঘিরে রেখেছিল চল্লিশ লাখ ‘আমি’। আর আমি নিজেকে সেঁটে রাখতাম, বিভিন্ন আকৃতির স্ক্রিনের সাথে, অপেক্ষায় থাকতাম পরবর্তী মৃত্যুর, চোখ বুলাতাম এমন বিশ্লেষণে কিভাবে কার্বফ্ল্যাট করা যায়, আর ডাউনলোড করতাম “নাগরিকদের চলাফেরার ব্যতিক্রমী সব কায়দা-কানুনের কনফার্মেশন” সংক্রান্ত পিডিএফ, যাতে দেখানো হতো কিভাবে একজন নিজের শরীরকে শহরের এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে টেনে নিয়ে যেতে পারবে। অবশ্য এইসব ততক্ষণই করা হয় যতক্ষন পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন উদ্দেশ্যমূলক নিয়মকানুন জারি আছে।

কবে যে এই অদ্ভুত সময়ের অবসান হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না! বারেবারে মনে হয়, এর বুঝি শেষ নেই। ইতিহাসের অদ্ভুত বাঁক হিসেবে, ২০২০ সালের বসন্তের দিকে আর হয়ত ফিরে তাকাবো না। ইতিহাসও কি কখনও এমন অপ্রত্যাশিত বাঁকে নিজেকে সক্রিয় করে তুলেছে? তারপরেও একে এক গুরুত্বপূর্ণ দশক হিসেবে দেখা হবে যেখানে আমরা বুঝে নিয়েছি, পরিকল্পিত কারফিউ মানুষকে আসলেই সীমানার জালে আটকে ফেলা ভৌগোলিক বেড়াজাল(geofencing), ভৌগোলিক নজরদারি(geotracking) এবং লুকোচুরির ব্যাপার-স্যাপার। দশকটাই শুরু হল উল্লাসে নয়, চুপিচুপিঃ কথায় আছে, “অনুশোচনার চাইতে সতর্কতাই শ্রেয়।”

____________

২৩শে মার্চ, ২০২০

অনুবাদকের টীকা

[i] রচনার শুরু থেকেই আন্তোনি ভ্রাদিস হেগেলের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন অর্থাৎ হেগেল যেখানে মনে করতেন ইতিহাস সবসময় সামনের দিকে ধাবমান এক উন্নয়নশীল প্রক্রিয়া, সেখানে লেখক মনে করেন তার উল্টোটা। previous (পূর্বে) ও preoccupied (ব্যতিব্যস্ত) এই দুইটা শব্দের pre অংশটুকু বাঁকা করে দিয়ে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রব্যাবস্থার প্রতি কিছুটা বাঁকাদৃষ্টি দিয়েছেন। এই পুঁজিবাদী ব্যাবস্থাপনায় ব্যাক্তিসাতন্ত্রবাদের চাপে সমাজের সম্মিলিত রুপটা যে আজ মৃত তা তিনি অকপটে লিখেছেন। গণমাধ্যমের ভুমিকাও যে আজ নেতিবাচক তাও তিনি জানিয়েছেন।

[ii] বব মার্লের “Burnin’ And Lootin’” গানের প্রথম লাইন ও ভ্রাদিসের এই লেখার শিরোনাম একই।

প্রথম প্রকাশঃ ১৪ই এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৪ই এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/2510409755918990/

https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%B0/%E0%A6%9C%E0%A6%97-%E0%A6%89%E0%A6%A0%E0%A6%9B-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%A7-%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A6%B2-%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%A8-%E0%A6%AD%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%B8

--

--

বোধিচিত্ত

বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার প্রয়াস। A South Asian Platform for Interdisciplinary Studies. Based in Dhaka.