নৈতিকতা-অতিরিক্ত অর্থে সত্য ও মিথ্যা — ফ্রেডরিখ নীটশে

বোধিচিত্ত
20 min readAug 28, 2021

--

[ফ্রেডরিখ নীটশের “Über Wahrheit und Lüge im außermoralischen Sinne” নামের প্রখ্যাত দার্শনিক প্রবন্ধটি ১৮৭৩ সালে লিখিত হয়। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। স্যসুরের ভাষাচিন্তায় আমরা ফিলোলজিতে প্রশিক্ষিত নীটশের এই প্রবন্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখতে পাব। তাছাড়াও দুর্দান্ত এই প্রবন্ধটি পরবর্তীকালে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে, বিশেষত উত্তরাধুনিক ও উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তাচর্চায়। নীটশের এই প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ “On Truth and Lie in an Extra-moral Sense” ছাপা হয়েছে The Portable Nietzsche গ্রন্থে। এই দার্শনিক প্রবন্ধটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাহমিদ আলম ফিহাদ। ফিহাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।]

একদা এই মহাবিশ্বের কোন দূরবর্তী কোণে, অগণিত সৌরজগতের মধ্যে জ্বলজ্বলে এবং স্বাধীনভাবে ঘুরতে থাকা একটি নক্ষত্র ছিল, যেখানে একদল চতুর প্রাণী জ্ঞান আবিষ্কার করেছিল। সেটা ছিল “বিশ্ব ইতিহাসের” সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে বড় প্রতারণাপূর্ণ মূহুর্ত(minute, মিনিট) — তবুও মাত্র এক মিনিট। প্রকৃতি কয়েকবার শ্বাস নেবার পর নক্ষত্রটি ঠান্ডা হয়ে আসে এবং এই চতুর প্রাণীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

কেউ হয়তো এরকম একটা গল্প আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু তারপরেও যথেষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারবে না যে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কতটা হতভাগ্যরূপে, কতটা ছায়াছন্ন ও পলায়নপর হিসেবে, কতটা গন্তব্যহীন এবং খেয়ালীভাবে প্রকৃতির মাঝে হাজির হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এটার কোন অস্তিত্ব ছিল না এবং যখন আবার এটার সময় ফুরিয়ে আসবে, তখনও কিছুই যায়-আসবে না। কারণ মনুষ্য জীবনকে ছাড়িয়ে অন্যকোন দিকে চালিত করতে পারবে এমন অধিকতর কোন উদ্দেশ্য এই বুদ্ধিবৃত্তির নেই। বরং এটা মানবসুলভ এবং শুধু এর অধিকারী ও উৎপাদনকারীই একে এতটা গুরুত্ব দেয়, যেন সারা বিশ্ব এটাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। কিন্তু আমরা যদি মশার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম, তাহলে জানতে পারতাম যে মশাও নিজের একই পরিমাণ গুরুত্ব নিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, নিজের ভেতর নিজেকে পৃথিবীর উড়তে থাকা কেন্দ্র হিসেবে অনুভব করে। প্রকৃতির মাঝে এতটা তুচ্ছ এবং ঘৃণ্য আর কিছু নেই যেটাকে এই জ্ঞানের সামান্য নিঃশ্বাসে একটা থলের মত তাৎক্ষণিকভাবে ফাটিয়ে ফেলা যাবে না; এবং যেমন করে সকল মুটে একজন পূজারী চায় (every porter wants an admirer), তেমনি দার্শনিক (সবচেয়ে গর্বিত মানু্‌ষটা) ভাবেন যে তাঁর কাজ এবং চিন্তার মধ্যে দিয়ে সে এই মহাবিশ্বের চোখে দূরবীণের মত দৃষ্টি দিয়ে তাকায়।

বুদ্ধিবৃত্তির এই ধরনের প্রভাব অবাক করার মত বিষয়। কেননা এটাকে দেয়া হয়েছিল সবচেয়ে দুর্ভাগা, সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী সত্তাটির একটা সহায়ক হিসেবে শুধুমাত্র, যাতে করে তারা একটা মিনিটের জন্য অস্তিত্বের মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে, যে বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়া এই অস্তিত্ব থেকে লেসিং-এর পুত্রের মত [জোহান জোয়াসিম এশেনবার্গকে (Johann Joachim Echenburg) লিখা একটি বিখ্যাত চিঠিতে (৩১শে ডিসেম্বর, ১৭৭৮) লেসিং নিজের পুত্রের মৃত্যু এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে “সে এই পৃথিবীকে এতটা ভালভাবে বুঝতে পেরেছিল যে প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্র সে এই পৃথিবী ত্যাগ করে”] যতটা দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যাওয়ার সকল কারণ বিদ্যমান। যে উদ্ধতভাব জ্ঞান এবং অনুভূতির সাথে তৈরি হয়, যা দৃষ্টি আচ্ছন্নকারী কুয়াশার মত মানুষের চোখ এবং চেতনাকে আবৃত করে রাখে, তা নিজের ভিতর বহন চলে করে জ্ঞানের নিজের সবচেয়ে অতিরঞ্জিত(flattering) মুল্যায়ন এবং সেকারণে মানুষকে তার নিজ অস্তিত্বের মূল্য সম্পর্কে প্রতারিত করে। এর সবচেয়ে সার্বজনীন প্রভাব হচ্ছে প্রতারণা; তবে এর সবচেয়ে নির্দিষ্ট প্রভাবটিরও অনেকটা একই বৈশিষ্ট্য আছে।

স্বতন্ত্র প্রাণীর (individual) টিকে থাকার একটি উপায় হিসেবে বুদ্ধিবৃত্তি নিজের মুখ্য ক্ষমতাটির প্রকাশ ঘটায় অনুকরণের (simulation) মধ্যে; কারণ এর মাধ্যমেই দুর্বলতর, কম বলিষ্ঠ প্রাণীরা নিজেদের টিকিয়ে রাখে, যেহেতু শিকারী প্রাণীর শিং কিংবা ধারালো দাঁত (fang) দিয়ে অস্তিত্বের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। মানুষের মধ্যে অনুকরণের এই শিল্প শীর্ষে পৌছায়ঃ এখানে প্রতারণা, চাটুকারিতা, মিথ্যাবাদিতা এবং হঠকারিতা, জাহির করা, পিঠ পিছে কথা বলা, ধার করা ঐশ্বর্যে জীবনযাপন, মুখোশ পরে থাকা, প্রচলিত রীতিনীতির ছদ্মবেশ, অন্যের সামনে এবং নিজের সামনে ভিন্ন চরিত্র নেয়া — সংক্ষেপে, আত্ম-অহংকারের একমাত্র শিখাটির চারপাশে ক্রমাগত ঝাপটানো এতটাই নিয়ম এবং আইনে পরিণত হয়েছে যে সত্যের জন্য একটা সৎ এবং খাঁটি প্রেরণা মানুষের মধ্যে কিভাবে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব, এর চেয়ে বেশি বোধেরও অতীত আর তেমন কিছু হতে পারে না। এরা বিভ্রম এবং স্বপ্নমূর্তিতে গভীরভাবে মগ্ন; এদের দৃষ্টি শুধু বস্তুর পৃষ্ঠতলের উপর দিয়েই চোখ বুলিয়ে যায় এবং তাদের আকার দেখে। এদের অনুভূতি এদেরকে সত্যের ধারের কাছেও চালিত করে না, বরং উদ্দীপনার (stimuli) গ্রহণেই সন্তুষ্ট রাখে নিজেকে, খেলতে থাকে, ঠিক যেন এটা বস্তু সমূহের পিঠে কানামাছি খেলার মত। তাছাড়াও, মানুষ সারাজীবন, রাতের বেলা নিজেকে প্রতারিত হতে দেয় যখন সে স্বপ্ন দেখে, এবং তার নৈতিক বোধ তাকে এ থেকে বিরতও করে না — যদিও বলা হয় প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির জোড়ে মানুষ নাক ডাকাও জয় করতে পেরেছে।

প্রকৃতপক্ষে, মানুষ নিজের সম্পর্কে আসলে কি জানে? সে কি নিজেকে একবারের জন্যও সম্পূর্ণরূপে দেখতে পারে, যেন সে একটা আলোকিত কাঁচের বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে এমনভাবে? প্রকৃতি কি তার থেকে তার নিজের প্রায় সবটাই লুকিয়ে রাখে না, এমন কি তার শরীরও, তাকে একটা গর্বিত, বিভ্রান্তিকর চেতনায় মোহচ্ছন্ন এবং আটকে রাখার জন্য, এবং অন্তের কুন্ডলী, রক্তস্রোতের দ্রুত প্রবাহ এবং তার সাথে জড়িত পেশির কাঁপন থেকে অনেক দূরে রাখার জন্য? প্রকৃতি চাবিটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে; এবং মানুষের বিপজ্জনক কৌতুহলকে সে শান্ত রাখে, যা হয়তো কোন এক ফাটল দিয়ে চেতনার প্রকোষ্ঠের ভিতর তাকাবে এবং দেখতে পাবে মানুষ বেঁচে থাকে নিষ্ঠুরতায়, লোভে, অতৃপ্তিতে, হত্যায়, নিজের অজ্ঞতার প্রতি উদাসীনতায় — স্বপ্নে ঝুলে থেকে, যেন তা ঝুলে আছে কোন একটা বাঘের পিঠের উপর। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, এই সম্পূর্ণ পৃথিবীর কোথা হতে সত্যের জন্য তাড়না আসবে?

যতক্ষণ পর্যন্ত একটা স্বতন্ত্র প্রাণী অন্য একটা স্বতন্ত্র প্রাণীর বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করতে চায়, প্রাকৃতিকভাবেই সে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায় শুধুমাত্র অনুকরণের (simulation) জন্য। কিন্তু যেহেতু মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে এবং একঘেয়েমির কারণে সামাজিকভাবে বাঁচতে চায়, দলবদ্ধ প্রাণী হিসেবে (herd-fashion), তার শান্তি-চুক্তির প্রয়োজন হয় এবং সে চেষ্টা করে অন্তত সবচেয়ে অসভ্য bellum omni contra omnes [সবার বিরুদ্ধে সবার যুদ্ধকে] বিতাড়িত করতে। এই শান্তি চুক্তি নিজের সাথে যা নিয়ে আসে তা দেখতে কিছুটা সত্যের প্রতি এই রহস্যময় তাড়না অর্জনের প্রথম ধাপের মত। আপাতত এখন থেকে কি “সত্য” বলে বিবেচিত হবে তা ঠিক হয়ে গেলঃ সেটা হচ্ছে, বস্তুসমূহের জন্য নিয়মিতভাবে বৈধ এবং বাধ্যতামূলক নাম (designation) আবিষ্কার, এবং এই ভাষাগত আইন সত্যের প্রথম নিয়মগুলোরও আকার দেয়ঃ কারণ এখানেই সবার প্রথমে সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টি হয়। মিথ্যাবাদী বস্তুর বৈধ নাম, শব্দকে ব্যবহার করে অবাস্তবকে বাস্তব দেখানোর জন্য; উদাহরণস্বরূপ- সে বলে “আমি ধনী” যেখানে তার অবস্থার সঠিক নাম (designation) হচ্ছে “গরীব”। ইচ্ছামত পরিবর্তন কিংবা নাম উল্টে দেয়ার মাধ্যমে সে স্থায়ী রীতি-নীতির অপব্যবহার করে। যখন সে অন্যের ক্ষতি করে এটা করে নিজের সুবিধার জন্য, তখন সমাজ তাকে আর বিশ্বাস করে না, বরং তাকে বর্জন করে। এ কারণে মানুষ প্রতারিত হওয়া থেকে ততটা দূরে থাকে না যতটা দূরে থাকে প্রতারণার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকেঃ এই পর্যায়ে তারা মূলত প্রতারণাকে ঘৃণা করে না। বরং নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের প্রতারণার ক্ষতিকর, বিপদজনক পরিণতিকে ঘৃণা করে। একই রকম সীমিত উপায়ে মানুষ সত্যকে চায়ঃ সে সত্যের মনোরম জীবন রক্ষাকারী পরিণতি চায়, কিন্তু বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতি সে উদাসীন, যে উদাসীনতার কোন ক্ষতিকারক পরিণতি নেই; এমনকি সে সম্ভাব্য ক্ষতিকারক এবং বিধ্বংসী সত্যের পরিপন্থী। এছাড়াও, ভাষার এই প্রচলিত নিয়মাবলী? এগুলো কি বাস্তবিকই জ্ঞান থেকে উৎপাদিত, সত্যের চেতনা থেকে সৃষ্ট? বস্তুসমূহ এবং তাদের নাম কি একে অন্যের অনুরূপ? ভাষা কি সকল বাস্তবতার উপযুক্ত অভিব্যক্তি(expression)?

একমাত্র বিস্মৃতির মাধ্যমেই — সঠিকভাবে আখ্যায়িত হয়েছে — এই অর্থে, মানুষ “সত্য”কে পাওয়ার বিভ্রম অর্জন করতে পারে। সে যদি অনুলাপের(tautology, স্বতঃসত্য) আকারে সত্য দ্বারা সন্তুষ্ট হতে না চায় — যা মূলত ফাঁপা খোলস — তাহলে সে চিরকালই সত্যের জায়গায় বিভ্রমকে গ্রহণ করবে। শব্দ আসলে কি? স্নায়ু উদ্দীপনা থেকে যে ছবি আসে তার ধ্বনিরূপ। কিন্তু স্নায়ু উদ্দীপনা থেকে কোন কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা, যা আমাদের বাইরে অবস্থিত — এর মানে হচ্ছে ইতিমধ্যেই তা যুক্তির মূলনীতির ভুল এবং অযৌক্তিক প্রয়োগ। ভাষার সৃষ্টিতে সত্যই যদি একমাত্র নির্ধারক (deciding factor) হতো, এবং নামকরণের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণই যদি চূড়ান্ত হতো, তাহলে এরপরও আমরা কিভাবে একথা বলার সাহস করতে পারি যে “পাথর শক্ত”, যেন “শক্ত” হচ্ছে এমন কোন কিছু যা আমাদের পরিচিত, এবং সম্পূর্ণরূপে নিছক বিষয়ীগত(subjective) উদ্দীপনা নয়। আমরা লিঙ্গের ভিত্তিতে বস্তুকে আলাদা করি, বৃক্ষকে (tree) পুরুষ এবং উদ্ভিদকে (Plant) নারী হিসেবে চিহ্নিত করি। কি সম্পর্কহীন নির্ধারণ! নিশ্চয়তার অনুশাসনের সীমা এটা কতটা লঙ্ঘন করে! আমরা “সাপ”-এর কথা বলিঃ এই নামটি নির্ধারিত হয় এর নিজেকে প্যাঁচানোর ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে এবং যেকারণে এই নাম তা কেঁচোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কি সম্পর্কহীন পৃথকীকরণ! কি ধরনের একতরফা পছন্দ, প্রথমে এটার ক্ষেত্রে, এরপর কোন বস্তুর বৈশিষ্ট্য-এর ক্ষেত্রে। বিভিন্ন ভাষা পাশাপাশি রাখলে, দেখা যায় যে শব্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সত্য মূলব্যাপার নয়, এবং যথাযথ অভিব্যক্তি কখনই নয়; তা না হলে এত রকমের ভাষা থাকতো না। “স্বয়ং বস্তু” (thing in itself, বস্তু স্বরূপ) [কারণ সেটাই হবে বিশুদ্ধ সত্য, কোন ধরনের পরিণতি ছাড়া] ভাষার স্রষ্টার সম্পূর্ণ বোধা্তীত এবং লক্ষ্য হিসেবে একবারেই মূল্যহীন। একজন শুধুমাত্র মানুষের সাথে বস্তুর সম্পর্কটির নামকরণ করে, এবং সেটা প্রকাশ করার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করে। একটি স্নায়ু উদ্দীপনা, প্রথমে স্থানান্তরিত হয় একটা ছবিতে — প্রথম রূপক। পালাক্রমে, সেই ছবিটির অনুকরণ (imitate) করা হয় একটি শব্দ দ্বারা — দ্বিতীয় রূপক। এবং প্রতিবার একটি বলয়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে একেবারে নতুন এবং পৃথক একটি বলয়ের ঠিক মাঝে ঝাঁপ দেয়া হয়। কেউ একজন কল্পনা করতে পারে এমন একটা মানুষ যে সম্পূর্ণ বধির এবং যার কখনও কোন শব্দ বা গান শোনার অনুভূতি হয়নি। এমন একজন মানুষ হয়তো ক্লাডনীর[Ernst Chladni, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ও মিউজিশিয়ান] শব্দ চিত্রগুলোর(sound figure) দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকাবে; হয়তো সে তারের কম্পনে এর কারণ আবিষ্কার করবে এবং এখন শপথ করে বলবে সে নিশ্চিতভাবে জানে মানুষ “শব্দ” বলতে কি বুঝায়। ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের জন্যই ঘটনাটা ঠিক এরকম। আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা বস্তুর স্বরূপের things themselves) ব্যাপারে জানি যখন আমরা গাছ, রঙ, তুষার এবং ফুলের কথা বলি; অথচ আমাদের কাছে বস্তুসমুহের রূপক ছাড়া আর কিছুই নেই — যেসব রূপক কোনভাবেই বস্তুর প্রকৃত সত্তাকে নির্দেশ করে না। ঠিক যেভাবে শব্দ বালুগঠিত চিত্র (sand figures) আকারে উপস্থিত হয়, তেমনিভাবে বস্তু স্বরূপের(thing in itself) সেই রহস্যময় “X” প্রথমে স্নায়ু উদ্দীপনায় উপস্থিত হয়, তারপর একটি ছবি হিসেবে এবং সবশেষে একটি শব্দ হিসেবে। এভাবে, ভাষার সৃষ্টি কোন ক্ষেত্রেই যুক্তিযুক্ত উপায়ে হয়না, এবং সকল উপাদান যার ভিতরে এবং যা দ্বারা সত্যের মানব(man of truth), বিজ্ঞানী, এবং দার্শনিকরা পরবর্তীতে কাজ করে এবং নির্মাণ করে, তা একেবারেই অস্তিত্বহীন কোন জগৎ থেকে উদ্ভুত না হয়ে থাকলেও, অন্তত বস্তুর সারসত্তা(essence) থেকে উদ্ভূত নয়।

তবুও আমরা এখন ধারণা কিভাবে তৈরি হয় সে ব্যাপারটি বিশেষভাবে বিবেচনা করি। প্রতিটি শব্দই তৎক্ষণাৎ ধারণায় পরিণত হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং অদ্বিতীয় যে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা তা মনে করিয়ে দেয়া শব্দের উদ্দেশ্য নয়, যে অভিজ্ঞতাই মূলত শব্দের জন্ম দেয়, কিন্তু একইসাথে একে অগণিত, কম বা বেশি একই ধরনের অভিজ্ঞতার উপযুক্ত হতে হয় — যার মানে হচ্ছে, কঠোরভাবে বলতে গেলে, কখনই সমতুল্য নয় — অন্য কথায়, শব্দকে অসংখ্য অসম অভিজ্ঞতার উপযুক্ত হতে হয়। প্রতিটি ধারণার জন্ম হয় যা অসম তা সমতুল্য করার মাধ্যমে। কোন পাতাই সম্পূর্ণভাবে অন্য পাতার সমতুল্য নয়, এবং “পাতা” ধারণাটি এই সকল স্বতন্ত্র পার্থক্য থেকে সম্পর্কহীন বিমূর্তায়ন(arbitrary abstraction)-এর মাধ্যমে এবং পার্থক্যগুলো ভুলে যাওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়; এবং এখন তা এই ধারণার জন্ম দেয় যে প্রকৃতিতে হয়তো অগণিত পাতার বাইরেও কিছু একটা আছে যেটা হচ্ছে “পাতা” — কোন এক ধরনের মূল নকশা যার থেকে সকল পাতা গঠন, চিহ্নায়ন, অনুকরণ, রঙ করা, কুঞ্চিত করা, এবং আঁকা হয়, তবে তা কোন অপটু হাতে, যে কারণে কোন অনুকরণই আসল নকশার সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য ছবি হয়ে উঠে না। আমরা একটা মানুষকে “সৎ” বলি। আমরা জিজ্ঞেস করি, “আজ সে কেন এত সৎ আচরণ করলো?” আমাদের উত্তর অনেকটা এরকম শোনায়ঃ তার সততার জন্য। সততা! যা আবারো এই কথা বলার মতইঃ আসল পাতাটি (মূল নকশা) সকল পাতার সৃষ্টির কারণ। কেননা আমরা “সততা” নামে কোন সত্তা-গত বৈশিষ্ট্যের কথা জানি না। আমরা শুধু অগণিত স্বতন্ত্র মানুষের কথা জানি, এবং সেই সাথে অসংখ্য অসম কাজ, যা আমরা সমান করি অসমতাগুলো উপেক্ষা করার মাধ্যমে, অতঃপর তাদের একত্রে সৎ কর্ম বলি। শেষ পর্যন্ত আমরা সেই কাজগুলো থেকে এক ধরনের qualitas occulta (গোপন বৈশিষ্ট্য) পরিশ্রুত করি যাদের নাম দেই সততা। তারপর যা স্বতন্ত্র এবং আসল, তা উপেক্ষা করার মাধ্যমে ধারণাটিকে আকার দেই; যেখানে কিনা প্রকৃতি কোন ধরনের ধারণা বা আকারের সাথে পরিচিত না, এবং একইভাবে কোন প্রজাতির সাথেও, বরং শুধুমাত্র সেই “X”-এর সাথে পরিচিত যাতে আমাদের কোন প্রবেশ(inaccessible) নেই [বা অনধিগম্য] এবং আমাদের পক্ষে যার সংজ্ঞায়ন সম্ভব নয়। কারণ, আমরা প্রজাতি এবং স্বতন্ত্র প্রাণীর মধ্যে যে পার্থক্য করি তাও নরত্বারোপমূলক (anthropomorphic) এবং এর সৃষ্টি বস্তুর সত্তা থেকে নয়; যদিও আমাদের এটা ধারণা করা উচিত নয় যে এই পার্থক্যের সাথে বস্তুর সত্তার কোন মিল নেইঃ সেটা অবশ্যই একটা গোঁড়ামিপূর্ণ দাবি হবে, যেহেতু তা এর বিপরীত দাবিটির মত অপ্রমাণযোগ্য।

সত্য তাহলে কি? রূপক, মেটেনমি(metonym) এবং নরত্বারোপন (anthropomorphism) দ্বারা তৈরি সচল(mobile) সৈন্যবাহিনী — সংক্ষেপে, মানুষের সম্পর্কের একটি সমষ্টি যে কাব্যিকভাবে এবং অলঙ্করণের মাধ্যমে বৃদ্ধি, পক্ষান্তরিত এবং সুসজ্জিত করা হয়েছে, এবং অনেকদিন ব্যবহারের পর যা মানুষের কাছে দৃঢ়, অনুশাসনিক এবং বাধ্যতামূলক মনে হয়ঃ সত্য হচ্ছে বিভ্রম এবং মানুষ ভুলে গেছে সত্য যে আসলে এটাই; রূপক যা ক্ষয়ে গেছে এবং যার কোন ইন্দ্রিয় ক্ষমতা নেই; এমন মুদ্রা যা তার উপর অঙ্কিত চিত্র হারিয়ে ফেলেছে এবং এখন এর মূল্য শুধু মাত্র ধাতু হিসেবে, আর মুদ্রা হিসেবে নয়।

আমরা এখনও জানি না সত্যের প্রতি তাড়না কোথা থেকে আসে; কারণ এখন পর্যন্ত আমরা শুধুমাত্র সমাজের আরোপিত এই বাধ্যবাধকতা শুনেছি যে এটা থাকা উচিতঃ সত্যবাদী হওয়া মানে হচ্ছে প্রচলিত রূপকগুলো ব্যবহার করা — নৈতিক অর্থেঃ একটা স্থায়ী নিয়মাবলী অনুসারে মিথ্যা বলার বাধ্যবাধকতা, গোত্রের মত একটা নির্দিষ্ট রীতিতে মিথ্যা বলা যা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। এখন, মানুষ অবশ্যই ভুলে যায় যে ব্যাপারগুলো তার জন্য এভাবে নির্ধারিত হয়ে আছে। এভাবেই মানুষ মিথ্যা বলে নির্দেশিত রীতিতে, অবচেতনভাবে এবং এমন অভ্যাস অনুযায়ী যা শত বছরের পুরনো; এবং ঠিক এই অবচেতন এবং বিস্মৃতির মাধ্যমেই সে সত্যের প্রতি তার এই চেতনায় পৌঁছায়। একজন মানুষ একটি বস্তুকে লাল, অন্যটিকে ঠান্ডা, এবং তৃতীয় একটি বস্তুকে বোবা বলে চিহ্নিত করার যে বাধ্যবাধকতা অনুভব করে, তা থেকেই সত্যের প্রতি নৈতিক তাড়না জন্মে। সত্যের প্রবীণতার প্রতি যে শ্রদ্ধা, সত্যের নির্ভরযোগ্যতা, এবং সত্যের উপযোগ, এগুলো একজন মানুষ আরেকজন মিথ্যাবাদীর বিপরীতে তুলনা করার মাধ্যমের নিজের সামনে তুলে ধরে, যে মিথ্যাবাদীকে সমাজে কেউ বিশ্বাস করে না এবং সকলে বর্জন করে। একজন যুক্তিসঙ্গত প্রাণী হিসেবে সে এখন নিজের নিয়ন্ত্রণ বিমূর্ত ধারণার হাতে তুলে দেয়। স্বজ্ঞা (intuition) দ্বারা এবং আকস্মিক উদ্দীপনা দ্বারা আলোড়িত হওয়া সে আর মেনে নিবে না। প্রথমে সে এই সকল উদ্দীপনাকে কম রঙিন, এবং আরও শান্ত ধারণায় পরিণত করার মাধ্যমে তাদের সার্বজনীন করে, যেন সে এগুলোকে নিজের জীবনের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিশ্বাস করতে পারে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে। যা কিছু মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করে তা নির্ভর করে তার এই ক্ষমতার উপর যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য(perceptual) রূপককে চিত্রে রূপান্তর করে এবং এ্কইভাবে সেই চিত্রকে ধারণায় আকার দেয়। কারণ এই ধারণার জগতে এমন কিছু সম্ভব যা কখনই সেই প্রাণবন্ত প্রথম উদ্দীপনা অর্জন করতে পারে নাঃ বর্ণ(caste) এবং উপাধী(degree) অনুযায়ী একটা পিরামিড বিন্যাস(pyramidal order) গঠন এবং নিয়ম, সুবিধা, অধীনতা, এবং সুস্পষ্ট সীমানার একটি নতুন পৃথিবী তৈরি — একটা নতুন দুনিয়া যা আরও দৃঢ়, আরও সার্বজনীন, আরও ভালভাবে পরিচিত এবং সরাসরি দেখা পৃথিবীর চেয়ে আরও মানবিক এবং এই কারণে নিয়মতান্ত্রিক এবং বেশি গুরত্বপূর্ণ একটি জগৎ হিসেবে, সেই প্রাণবন্ত প্রথম উদ্দীপনার যে জগৎ তার সম্মুখীন হয়। যেখানে প্রতিটি ইন্দ্রিয় উদ্ভুত রূপক স্বতন্ত্র এবং অসমতুল্য এবং যেকারণে সকল শ্রেণীবিন্যাসের উর্ধ্বে, সেখানে ধারণার সেই বিশাল প্রাসাদ রোমান কলাম্বারিয়াম(columbarium)-এর মত কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতা প্রদর্শন করে এবং যুক্তিতে এমন শক্তি এবং শীতলতা(coolness) দেখায় যা মূলত গণিতশাস্ত্রের চরিত্রে দেখা যায়। যেকোন মানুষ যে যুক্তির এই শীতল নিঃশ্বাস অনুভব করেছে, তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এমনকি ধারণাও — যা একটি ছাঁচের মতই হাড্ডিসার, চতুষ্কোণ, এবং পরিবর্তনযোগ্য — শুধুমাত্র একটা রূপকের অবশিষ্ট, এবং স্নায়ু উদ্দীপনা থেকে চিত্রের শৈল্পিক রূপান্তরের সাথে যে বিভ্রম জড়িত, সেই বিভ্রম যদি প্রতিটি ধারণার মাতা নাও হয়ে থাকে, অন্তত মাতামহী হবে। কিন্তু ধারণার এই বিশ্রী খেলায় সত্য মানে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ তাদের নির্দেশিত নিয়মে ব্যবহার করা, তাদের স্থান সঠিকভাবে গণনা করা, সঠিক বিন্যাসে বিন্যস্ত করা, এবং কখনই বর্ণ এবং শ্রেণীর ক্রমকে না ভাঙ্গা। যেভাবে রোমান এবং এট্রোস্কানরা(Etruscan) স্বর্গলোককে নির্দিষ্ট গাণিতিক সীমানায় বিভক্ত করে দিয়েছিল এবং প্রতিটি বিভক্ত স্থানে একজন ঈশ্বরকে আবদ্ধ করেছিল এমনভাবে, যেন একটা templum বা মন্দিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেরকম ভাবে প্রতিটি মানুষের মাথার উপরে গাণিতিকভাবে বিভক্ত এবং ধারণা দ্বারা তৈরি একটি স্বর্গলোক রয়েছে এবং এই কারণে তারা মনে করে সত্যের দাবী হচ্ছে প্রতিটি ঈশ্বরকে তার নিজ নিজ স্থান অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ হয়তো মানুষের প্রশংসা করতে পারে নির্মাণ শিল্পের প্রতিভা হিসেবে, যে কিনা অস্থিতিশীল ভিত্তির উপর ধারণা দ্বারা নির্মিত অসীম পরিমাণ জটিল অট্টালিকার স্তুপ তৈরি করেছে, যেন তা প্রবাহমান জলের উপর তৈরি। অবশ্যই, এরকম একটি ভিত্তিকে অবলম্বন করার জন্য তার নির্মাণ হতে হবে মাকড়সার তৈরি জালের মতঃ বাতাসের ঢেঊয়ে দুলতে পারবে এরকম সূক্ষ্ম, কিন্তু আবার বাতাসের ঘূর্ণিতে ছিড়ে যাবে না এতটা শক্ত। নির্মাণশৈলির প্রতিভা হিসেবে মানুষ নিজেকে মৌমাছির চেয়ে অনেক উপরে উন্নীত করে, এইভাবে যেঃ যেখানে মৌমাছি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত মোম দ্বারা নির্মাণ করে, সেখানে মানুষ নির্মাণ করে অনেক বেশি সূক্ষ্ম ধারণা নির্মিত উপাদান দ্বারা, যে উপাদান প্রথমে তার নিজের ভিতর থেকে উৎপাদন করতে হয়। এক্ষেত্রে সে অনেক প্রশংসার দাবিদার, তবে সে প্রশংসা বস্তুর যে সত্য তার প্রতি অথবা বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতি তার তাড়নার জন্য নয়। একজন যদি ঝোপের আড়ালে কিছু একটা লুকায় এবং পরবর্তীতে একই জায়গার তা খুঁজে এবং পেয়ে যায়, তাহলে সেই খোঁজ এবং পাওয়ার মধ্যে প্রশংসা করার মত কিছু নেই। কিন্তু সত্যের খোঁজাখুঁজি এবং পাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তির জগতে ব্যাপারগুলো এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি যদি স্তন্যপায়ী প্রাণীর একটা সংজ্ঞা তৈরি করি এবং এরপর একটা উট পর্যবেক্ষণ করার পর ঘোষণা করি, “দেখ, একটা স্তন্যপায়ী প্রাণী”, এই অর্থে আমি বাস্তবিকই একটা সত্যকে আলোতে এনেছি, কিন্তু এই সত্যের মূল্য সীমিত। এর মানে হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণভাবে একটি নরত্বারোপিত (anthropomorphic) সত্য যার মধ্যে এমন একটাও বিবৃতি নেই যা স্বয়ং সত্য (true in itself) হবে অথবা সার্বজনীন এবং বাস্তবিক অর্থে মানুষের চেতনা হতে বিচ্ছিন্ন কোন সত্য হবে। শেষ পর্যন্ত, এই ধরনের সত্যের পর্যবেক্ষণকারী যা খুঁজে তা হচ্ছে এই পৃথিবীর মনুষ্যরূপে রূপান্তর। সে এই পৃথিবীকে বুঝতে চায় মানুষের অনুরূপে, এবং সে সর্বোচ্চ আত্মীকরণের(assimilation) অনুভূতি অর্জন করতে পারে। যেভাবে জ্যোতিষীরা মনে করে নক্ষত্ররাজি তার সেবায় নিয়োজিত এবং তার সুখ ও দুঃখের সাথে জড়িত, অনুরূপভাবে এই ধরনের পর্যবেক্ষক মনে করে সারা মহাবিশ্ব মানুষের সাথে যুক্তঃ সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব একটি মূল শব্দ-মানবের(sound-man) অসীম সংখ্যক ভাঙ্গা প্রতিধ্বনি; সম্পূর্ণ মহাবিশ্ব একটি মূল চিত্র-মানবের (picture-man) অসীম সংখ্যক অনুকরণ। তার পদ্ধতি হচ্ছে মানুষকে সকল কিছুর মাপকাঠি হিসেবে বিচার করা, কিন্তু এটা করার মাধ্যমে সে এই ভুল বিশ্বাস থেকে শুরু করে যে এই সব জিনিস [যা সে পরিমাপ করতে চায়] তার সামনে সরাসরি নিছক বস্তু হিসেবে উপস্থিত আছে। সে ভুলে যায় যে মূল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপকগুলো শুধুই রূপক এবং সেগুলোকে প্রকৃত বস্তু(things themselves, বস্তু স্বরূপ) মনে করে।

একমাত্র রূপকের এই আদিম পৃথিবী ভুলে যাওয়ার মাধ্যমেই কারো পক্ষে কোন ধরনের শান্তি, নিরাপত্তা এবং সামঞ্জস্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভবঃ শুধুমাত্র ছবির এই বিশাল স্তুপকে প্রস্তুরীভূত এবং জমাট বাঁধানোর মাধ্যমে, যে ছবি মূলত মানুষের কল্পনার আদিম অনুষদ থেকে জ্বলন্ত তরলের মত প্রবাহিত হয়েছে, শুধুমাত্র এই অপরাজেয় সত্য মেনে নেয়ার মাধ্যমে যে এই সূর্য, এই জানালা, এই টেবিল, এগুলো নিজের মধ্যেই সত্য(true in itself), সংক্ষেপে, সে নিজে যে একজন শৈল্পিক স্রষ্টা, শুধুমাত্র এটা ভুলে যাওয়ার মাধ্যমেই একজন মানুষ শান্তি, নিরাপত্তা এবং সামঞ্জস্যতা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। যদি এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাসের এই কয়েদখানা থেকে সে পালাতে পারে, তার “আত্মসচেতনা” তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এমনকি তার নিজের কাছে এই ব্যপারটা মেনে নেয়া খুব কঠিনও যে একটা পতঙ্গ বা একটা পাখি মানুষের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দুনিয়া প্রত্যক্ষণ করে এবং কার প্রত্যক্ষণ বেশি সঠিক এই প্রশ্নটিও একেবারে অর্থহীন, কেননা এই উত্তরের জন্য সঠিক প্রত্যক্ষণের মানদন্ড অনুযায়ী তা আগে থেকেই ঠিক করে নিতে হবে, অর্থাৎ, এমন একটি মানদন্ড অনুযায়ী তা ঠিক করে নিতে হবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। যাই হোক, আমার কাছে মনে হয় যে সঠিক প্রত্যক্ষণ — যার মানে হবে চিন্তার কর্তার(subject) মধ্যে চিন্তার বিষয় বা বস্তুর যথাযথ প্রকাশ — একটা স্ববিরোধী অসম্ভাব্যতা। কারণ সম্পূর্ণ বিপরীত দুইটি পরিমন্ডলের মধ্যে (অর্থাৎ চিন্তার কর্তা এবং বিষয় বা বস্তুর মধ্যে) কোন ধরনের কার্যকারণ সম্পর্ক, সঠিক মানদন্ড এবং অভিব্যক্তি নেই। থাকলে বড়জোর একটা নান্দনিক সম্পর্ক আছেঃ আমি বুঝাচ্ছি একটা ইঙ্গিতপূর্ণ আদান-প্রদান, সম্পূর্ণ বিজাতীয় একটি ভাষায় তোতলানো অনুবাদ — যার জন্য প্রয়োজন, যেকোন ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে তৈরি একটি অন্তর্বর্তী মাধ্যম এবং সমন্বয়কারী শক্তি। প্রতিভাস(appearance) এমন একটি শব্দ যা অনেক ধরনের প্রলোভন বয়ে বেড়ায়, যেকারণে আমি শব্দটি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি। কারণ এটা সত্য নয় যে আমাদের অভিজ্ঞতার জগতে(empirical world) বস্তুর প্রকৃতসত্তা প্রকাশিত হয় । একজন হাত ছাড়া চিত্রশিল্পী যে গানের মাধ্যমে নিজের কল্পনার ছবিটি ফুটিয়ে তুলতে চায়, শিল্পের পরিমন্ডলের এই স্থানান্তরের সত্ত্বেও সেই শিল্পী অভিজ্ঞতার জগতের চেয়ে ভালভাবে বস্তুর প্রকৃতসত্তাকে প্রকাশ করতে পারবে। এমনকি স্নায়ু উদ্দীপনার সাথে সৃষ্ট চিত্রটির সম্পর্কটিও অত্যাবশ্যকীয় নয়। কিন্তু যখন একই চিত্র লক্ষ লক্ষ সৃষ্টি হবে এবং অনেক প্রজন্ম ধরে তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দেয়া হবে এবং সবশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রতিবার সেটা একই ক্ষেত্রে আবির্ভূত হবে, তখন অবশেষে তা সেই একই অর্থ অর্জন করবে যা, যা সে অর্জন করতো যদি এটা একমাত্র অত্যাবশ্যকীয় চিত্র হতো, এবং মূল স্নায়ু উদ্দীপনার সাথে এই সৃষ্ট চিত্রটির সম্পর্ক কঠোরভাবে একটা কার্যকারণ সম্পর্ক হতো। একইভাবে, অনন্তকাল ধরে পুনরাবর্তিত একটি স্বপ্ন নিশ্চিতভাবেই বাস্তব বলে অনুভূত এবং বিবেচিত হবে। কিন্তু একটি রূপকের দৃঢ় এবং ঘন হয়ে উঠা এটার প্রয়োজনীয়তা এবং বিশেষ ন্যায্যতার ব্যাপারে কোন কিছুই নিশ্চিত করতে পারে না।

এইধরনের চিন্তার সাথে পরিচিত প্রতিটি ব্যক্তি নিঃসন্দেহে এই ধরনের সকল ভাববাদের (idealism) প্রতি গভীর অনাস্থা অনুভব করেছেঃ ঠিক যেভাবে প্রায়শই সে বেশ তাড়াতাড়ি প্রকৃতির নিয়মের চিরন্তন দৃঢ়তা, সর্বত্র এর উপস্থিতি এবং ভুল করবার প্রবণতার ব্যাপারে নিজেকে নিশ্চিত করেছে। সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানে প্রবেশ করতে পারি — দূরবীণতূল্য উচ্চতা থেকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মত গভীরতায় — সবকিছু নিরাপদ, সম্পূর্ণ, অসীম, স্বাভাবিক এবং ফাটলবিহীন। বিজ্ঞান এই একই খাদে চিরকাল সফলভাবে খনন করে যেতে পারবে এবং যা সে আবিষ্কার করবে সেগুলো পরষ্পরবিরোধী হবে না। কিন্তু কল্পনায় উৎপাদিত বস্তুর সাথে এর কত অমিল, কারণ সত্যিই যদি তা হতো, তাহলে এমন কোন জায়গা থাকতো যেখানে বাস্তবতা এবং ভ্রম নৈর্ব্যক্তিক(devined) হতে পারতো। এর বিরুদ্ধে এই কথাটি বলা বাঞ্ছনীয়ঃ আমাদের প্রত্যেকের যদি ভিন্ন ধরনের ইন্দ্রিয় অনুভূতি থাকত — আমরা যদি এখন বস্তুসমূহ একটি পাখির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষণ করতে পারতাম, আবার একটি কেঁচোর দৃষ্টিকোণ হতে, এরপর আবার গাছ হিসেবে, অথবা আমদের মধ্যে কেউ একজন যদি ইন্দ্রিয় উদ্দীপনা থেকে লাল দেখতো, অপরজন নীল, এবং আরেকজন একই উদ্দীপনাকে শব্দ হিসেবে শুনতো — তাহলে কেউ প্রকৃতির এধরনের স্বাভাবিকতার কথা বলতো না, বরং প্রকৃতি সর্বোচ্চ মাত্রায় আত্মগত(subjective) একটি সৃষ্টি হিসেবে অনুভূত হতো। কেননা, এই ধরনের প্রকৃতির নিয়ম আসলে আমাদের কাছে কি শেষপর্যন্ত? আমরা এর স্বয়ং(in itself) বা স্বরূপের সাথে পরিচিত নই। বরং পরিচিত শুধুমাত্র এর প্রভাবের সাথে, যার মানে হচ্ছে অন্য প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে এর যে সম্পর্ক শুধু সেটার সাথে পরিচিত — যা কিনা আবার শুধুমাত্র সম্পর্কের সমষ্টি হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত।

এই কারণে এই সকল সম্পর্ক শুধুমাত্র আরেকটি সম্পর্ককে নির্দেশ করে এবং এদের সারসত্তা বোঝা আমাদের জন্য সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। এই সকল প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে আমরা আসলে তাই জানি যা আমরা নিজেরা আরোপিত করি — অর্থাৎ সময় এবং স্থান, অতএব ক্রম এবং সংখ্যার সম্পর্ক। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের যা কিছু বিস্ময়কর, যা কিছু আমাদের চমৎকৃত করে এবং ব্যাখ্যার দাবিদার বলে মনে হয়, এবং যা কিছু আমাদের ভাববাদকে অবিশ্বাস করার দিকে চালিত করতে পারেঃ আমরা সময় এবং স্থানকে যে গাণিতিক কঠোরতায় এবং অলঙ্ঘনীয়রূপে উপস্থাপন করেছি, এসব কিছুই তার মধ্যে বন্দী। কিন্তু আমরা এসকল উপস্থাপনা তৈরি করেছি আমাদের নিজেদের মধ্যে থেকেই, সেই একই প্রয়োজনীয়তা থেকে যে প্রয়োজনীয়তা থেকে মাকড়সা জাল বোনে। আমাদের যদি সব কিছুকে এসকল আকৃতির ভিতর দিয়েই বুঝতে বাধ্য করা হয়, তখন এটা আর বিস্ময়কর থাকে না যে আমরা সব কিছুতে এই আকৃতিগুলো ছাড়া আর কিছুই ধরতে পারি না আসলে। কারণ এ সবকিছুই নিজের ভিতর সংখ্যার নিয়ম ধারণ করে, এবং সকল কিছুর মধ্যে নিহিত থাকা এই সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর ব্যাপার। নিয়মের প্রতি এই ধরনের সম্মতিজ্ঞাপন, যে সকল নিয়ম নক্ষত্ররাজির চলাফেরায় এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রকাশ পেয়ে আমাদের অবাক করে, তা অবশেষে সেই সকল বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায় যেগুলো আমরা নিজেরা বস্তুর উপর আরোপ করি। অতএব আমরাই নিজেদের এই উপায়ে বিস্মিত করি। একই সাথে এটা বলাও অত্যাবশ্যক যে, যে শৈল্পিক উপায়ে রূপকগুলো গঠিত হয়, যা থেকে আমাদের মধ্যে সকল অনুভূতির শুরু, তা এই আকৃতিগুলো পূর্বেই ধরে নেয়(presupposes) এবং একারণে সকল কিছুর মধ্যে এগুলো প্রকাশ পায়। রূপকগুলো থেকে পরবর্তীকালে যে উপায়ে ধারণা দ্বারা নির্মিত সম্পূর্ণ নতুন, জটিল সুবিশাল কাঠামো নির্মাণ করা হয় তা একমাত্র এই সকল আদি আকৃতির অস্তিত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এর মানে হচ্ছে, এই ধারণা দ্বারা নির্মিত কাঠামোগুলো রূপকের পরিমণ্ডলে কালিক, স্থানিক এবং সংখ্যাসূচক সম্পর্কসমূহের অনুকরণ করে।

আমরা দেখেছি কিভাবে ভাষাই মূলত ধারণা(concepts) নির্মাণে কাজ করে, যে পরিশ্রমটি পরবর্তীতে বিজ্ঞান অধিকার করে নেয়। যেভাবে মৌমাছি প্রতিনিয়ত প্রকোষ্ঠ গঠন করে এবং তা মধু দ্বারা পূর্ণ করে, তেমনিভাবে বিজ্ঞান অবিরামভাবে ধারণার সুবিশাল স্তম্ভসমূহে কাজ করে যায়, যা হচ্ছে মূলত প্রত্যক্ষণের সমাধিক্ষেত্র। সে সবসময়ই নতুন, উচ্চতর তলা নির্মাণ করে যাচ্ছে এবং পুরাতন ঘরগুলোকে শক্তিশালী করছে, পরিষ্কার করছে এবং নতুন রূপ দান করছেঃ সর্বোপরি সে এই বিকট উঁচু কাঠামোগুলো পূর্ণ করে চলেছে এবং এগুলোর ভিতর সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার জগতটা সাজাচ্ছে, যার মানে হচ্ছে নরপারোত্বমূলক জগৎকে সাজাচ্ছে। যেখানে তৎপর মানুষ যুক্তি এবং এর ধারণায় নিজের জীবনকে বেঁধে নেয় যেন সে ভেসে না যায় এবং হারিয়ে না যায়, বৈজ্ঞানিক পর্যাবেক্ষনকারী নিজের কুটিরটি তৈরি করে বিজ্ঞানের দুর্গের পাশে যাতে সে সেখানে কাজ করতে পারে এবং বর্তমানে বিদ্যমান এর সুরক্ষা প্রাচীরের ভিতর আশ্রয় নিতে পারে। তার আশ্রয়ের দরকার হয়, কেননা এমন ভয়াবহ শক্তি আছে যারা ক্রমাগত তার উপর আছড়ে পড়ে, যে সকল শক্তি বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধিতা করে এবং তাদের ঢালে বহন করে সবচেয়ে বেশী প্রজাতির প্রতীক।

রূপক গঠনের তাড়না মানুষের সবচেয়ে মৌলিক মানবিক তাড়না, যাকে কেউ এক মুহূর্তের জন্যও নিজের চিন্তা থেকে দূর করতে পারে না। কারণ তা করলে মানুষ, মানুষ হওয়া থেকেই দূরে সরে যাবে। একটি নতুন দৃঢ় পৃথিবী তৈরি হয়েছে এর কয়েদ হিসেবে, তারই ক্ষণজীবি সৃষ্টি যে ধারণা তার দ্বারা। কিন্তু নতুন পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ায় এই তাড়না সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়না এবং কদাচিৎ-ই দমিত হয়। সে নতুন একটা জগৎ এবং অন্য একটা উপায় অনুসন্ধান করে নিজের কাজের জন্য এবং সচরাচর মিথ ও শিল্পে তা খুঁজে পায়। এই তাড়না নতুন স্থানান্তর, রূপক এবং মেটেনমি দ্বারা ধারণার শ্রেণী ও বিভাগগুলোকে ক্রমাগত বিহ্বল করে। পৃথিবীকে নতুন করে সাজানোর একটি জ্বলন্ত আকাঙ্ক্ষাকে এটি ক্রমাগত রূপ দেয়, যা জাগ্রত মানুষের সামনে নিজেকে হাজির করে, যাতে করে তা স্বপ্নের মতই রঙিন, অনিয়মিত, ফলাফল ও সঙ্গতিহীন, মনোমুগ্ধকর, এবং চিরনতুন হয়। প্রকৃতপক্ষেই, ধারণার এই কঠোর এবং নিয়মিত জাল দ্বারাই শুধুমাত্র একজন জাগ্রত মানুষ বুঝতে পারে যে সে জেগে আছে; এবং ঠিক একারণেই মাঝেমাঝে সে ভাবে যে সে স্বপ্ন দেখছে, যখন এই ধারণার জাল শিল্প ছিড়ে ফেলে। [ব্লেইজ] প্যাসকেল যথার্থভাবেই বলেছেন যে, আমরা যদি প্রতিরাতে একই স্বপ্ন দেখি, তা নিয়ে আমরা ততটাই ব্যস্ত হয়ে উঠবো, যতটা আমরা প্রতিদিনের জীবনে দেখা বস্তুগুলো নিয়ে হয়ে উঠি। প্যাসকেল বলেছিল, “যদি কোন শ্রমজীবী নিশ্চিতভাবে প্রতিরাতে টানা বারো ঘন্টা স্বপ্ন দেখতো যে সে রাজা, আমি বিশ্বাস করি সে ততটাই খুশি হতো যতটা খুশি একজন রাজা হবে যে কিনা প্রতি রাতে বারো ঘন্টা স্বপ্ন দেখে যে সে একজন শ্রমজীবী।” এমনকি, যেভাবে মিথগুলো প্রশ্নাতীতভাবে ধরে নেয় যে অলৌকিক ঘটনা সবসময় ঘটেই চলেছে, একইভাবে মিথ দ্বারা অনুপ্রাণিত মানুষের জাগ্রত জীবনও — যেমন প্রাচীন গ্রিসের মানুষরা — স্বপ্নের সাথে বেশি মিলে যায়, বৈজ্ঞানিকভাবে মোহমুক্ত চিন্তাবিদের জাগ্রত জীবনের তুলনায়। যখন প্রতিটি গাছ হঠাৎ একটা পরী হিসেবে কথা বলতে পারে, যখন কোন ঈশ্বর ষাঁড়ের রূপে এসে কোন কুমারীকে নিয়ে যেতে পারে, যখন স্বয়ং দেবী এথিনাকে দেখা যায় সুদৃশ্য অশ্বদল নিয়ে পাইসাসট্রাটুস (Peisistrartus)-এর সাথে যাচ্ছে এথেন্সের বাজারের মধ্য দিয়ে — এবং একজন সৎ এথেন্সবাসী এগুলোই বিশ্বাস করতো — তখন স্বপ্নের মত, প্রতি মুহূর্তেই সবকিছু সম্ভব এবং সমস্ত প্রকৃতি মানুষের আশেপাশে এমনভাবে ঝাঁক বাঁধে যেন তা ঈশ্বরদের ছদ্মবেশ ছাড়া আর কিছুই না, যারা কিনা মানুষকে এই সকল রূপে বিভ্রান্ত করে নিজেদের মনোরঞ্জন করছে।

কিন্তু মানুষের একটা অপরাজেয় ঝোঁক আছে নিজেকে বিভ্রান্ত হতে দেয়ার। কোন গল্পকার যখন তাকে কোন ধ্রুপদী উপকথা শোনায়, অথবা কোন অভিনেতা থিয়েটারে সত্যিকারের রাজার চাইতেও বেশী রাজকীয় অভিনয় করে, তখন যেন সে খুশিতে মোহগ্রস্ত হয়ে উঠে, এমনভাবে যেন সেসব গল্প আসলে সত্যি। যতক্ষণ পর্যন্ত তা কোন রকমের ক্ষতি ছাড়াই বিভ্রান্ত করতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতারণার গুরু — বুদ্ধিবৃত্তি, স্বাধীন থাকে; এটা এর পূর্বের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয় এবং এর স্যাটার্নালিয়া[saturnalia, বন্য আনন্দোৎসবের প্রাচীন রোমান উৎসব] উদযাপন করে। আগে কখনই তা এর চেয়ে বেশি বিলাসিতাপূর্ণ, এর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ ও গর্বিত এবং এর চেয়ে বেশী চতুর ও সাহসী ছিল না। সৃষ্টিশীল আনন্দে সে রূপকগুলোকে বিশৃঙ্খলায় ছুড়ে দেয় এবং বিমূর্তায়নের সীমান্ত প্রস্তরগুলোকে স্থানচ্যুত করে, যাতে করে সে, উদাহরণস্বরূপ, জলস্রোতকে চিহ্নিত করে “গতিশীল পথ হিসেবে যা মানুষকে বহন করে, যেখানে অন্যথায় মানুষ হেঁটে যেত।” বুদ্ধিবৃত্তি এখন নিজের মধ্য থেকে দাসত্বের নিদর্শন সরিয়ে ফেলেছে। অন্য সময় বিষণ্ন দাপ্তরিক মনোভাবে(officiousness) সে চেষ্টা করে, সেসব দুর্বল প্রাণীকে পথ দেখাতে এবং উপায় প্রদর্শন করতে যারা অস্তিত্ব কামনা করে; সে তখন দাসের মত, যে মনিবের জন্য শিকার এবং লুণ্ঠনের সন্ধানে যায়। কিন্তু এখন সে নিজেই মনিব হয়ে উঠেছে, যে নিজের চেহারা থেকে দীনতার অভিব্যক্তি মুছে ফেলে। তার পূর্বের সকল কাজের তুলনায় এখনের কৃতকর্ম কপটতার চিহ্ন বহন করে, যেমনভাবে পূর্ববর্তী কাজগুলো বিকৃতির(distortion) চিহ্ন বহন করতো। এই মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তি মনুষ্য জীবনের অনুকরণ করে, কিন্তু তা এই জীবনকে ভাল কিছু হিসেবে দেখে এবং এই জীবন নিয়ে তাকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হয়। সেই বিশাল কাঠামো এবং ধারণার বিন্যাস যা অভাবী মানুষ নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিরকাল আঁকড়ে থাকে তা এই মুক্তিপ্রাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তির কাছে তার সবচেয়ে দুঃসাহসী কৃতকর্মের জন্য ব্যবহৃত খেলনা এবং মাচা(scaffolding) ছাড়া আর কিছুই না। এবং যখন সে এ কাঠামোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে এবং তাদের বিশৃঙ্খলায় ছুড়ে দেয়, এবং আবার তাদের যুক্ত করে একটা শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে, সবচেয়ে বিজাতীয় বস্তুগুলোকে একত্রিত এবং সবচেয়ে নিকটস্থ বস্তুগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে, তখন সে এটাই প্রদর্শন করে যে তার এসব সাময়িক দীনতার প্রয়োজন নেই এবং এখন থেকে সে ধারণা নয় বরং স্বজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত হবে। এমন কোন স্বাভাবিক রাস্তা নেই যা স্বজ্ঞা থেকে ভূতুরে ধারণার (schemata) দেশে, বিমূর্তায়নের জগতে, পথ দেখায়। এই সকল স্বজ্ঞার জন্য কোন শব্দের অস্তিত্ব নেই; যখন মানুষ এগুলো দেখে তারা হতবিহ্বল হয়ে যায়, অথবা সে শুধুমাত্র নিষিদ্ধে রূপক ব্যবহার করে এবং ধারণার অশ্রুতপূর্ব সমাহারে কথা বলে। সে এরকমটা করে যেন ধারণার এই প্রতিবন্ধকতাকে উপহাস এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ করার মাধ্যমে অন্তত সৃজনশীলভাবে বর্তমান স্বজ্ঞার যে শক্তিশালী প্রভাব, তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে।

অনেক অনেক যুগেই যুক্তিবাদী মানব এবং স্বজ্ঞালব্ধ মানব পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, যার একজন স্বজ্ঞাকে ভয় পায়, আরেকজন বিমূর্তায়নকে অবজ্ঞা করে। পরেরজন ততটাই অযৌক্তিক, আগেরজন যতটা শিল্পবোধহীন। তারা দুজনেই চায় জীবনের উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করতেঃ আগেরজন তা করে দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতার মাধ্যমে কিভাবে মৌলিক চাহিদাগুলো অর্জন করা যায় তা জানার মাধ্যমে; পরেরজন “অতীব-আনন্দিত নায়ক” হিসেবে এই সকল প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে, যে কিনা সেই জীবনকেই বাস্তব হিসেবে গণ্য করে যা বিভ্রম এবং সৌন্দর্যের ছদ্মবেশে থাকে। যখনই (যেমনটা সম্ভবত প্রাচীন গ্রিসে হয়েছিল) স্বজ্ঞালব্ধ মানব তার অস্ত্র তার যুক্তিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় অধিক কর্তৃত্বের সাথে এবং বিজয়ীভাবে পরিচালনা করতে পারে, তখন অনুকূল অবস্থা পেলে, একটা সংস্কৃতি সেখানে আকার পেতে পারে এবং জীবনের উপর শিল্প আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। এ ধরনের জীবনের সকল প্রকাশের সঙ্গী হয় কপটতা (dissimulation), দীনতার এই অস্বীকৃতি, প্রতীকী স্বজ্ঞার এই চাকচিক্য এবং সাধারণভাবে, বিভ্রমের এই প্রত্যক্ষতাঃ না এই বাড়ি, না এই চলনভঙ্গি, না এই পোশাক-আশাক, না এই মাটির কলস, এদের কোনটাই প্রমাণ করে না-যে এরা খুব জরুরী প্রয়োজন থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে। মনে হয় যেন এদের সকলের উদ্দেশ্য ছিল আনন্দের প্রকাশ ও উল্লাস, একটা অলিম্পিয়ান মেঘহীনতা, এবং এ যেন ছিল গাম্ভীর্যের সহিত খেলা করার মত। যে মানুষ ধারণা এবং বিমূর্তায়ন দ্বারা পরিচালিত সে এই সকল পন্থা দ্বারা শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যকে দূরে ঠেলতে সক্ষম হয়, কিন্তু কখনও এই সকল বিমূর্তায়ন থেকে নিজের জন্য সুখ অর্জন করতে পারে না। যখন তার লক্ষ্য হয় দুঃখ থেকে সর্বোচ্চ রকমের স্বাধীনতা অর্জন, তখন স্বজ্ঞালব্ধ মানব, একটা সংস্কৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে, তার স্বজ্ঞা থেকে ক্রমাগত অন্তঃপ্রবাহমান আলো, আনন্দ এবং পরিশুদ্ধির(redemption) ফসল তুলে — সেই সাথে দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষাও অর্জন করে। নিশ্চিতভাবেই, সে অনেক তীব্রভাবে পীড়িত হয়, যখন সে পীড়িত হয়; এবং সে প্রায়শই যন্ত্রনা ভোগ করে, যেহেতু সে তার অভিজ্ঞতা থেকে কোন শিক্ষা নেয় না এবং বারবার একই খাদে পড়তে থাকে। সুতরাং সে দুঃখে ততটাই অযৌক্তিক যতটা অযৌক্তিক সে সুখেঃ সে চিৎকার করে কাঁদে এবং কোন সান্ত্বনা গ্রহণ করে না। নির্বিকার মানব(stoical man) যে কিনা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয় এবং নিজেকে ধারণা দ্বারা পরিচালিত করে, সে কতটা ভিন্নভাবে একই দুর্ভাগ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়! এই মানুষটি, যে অন্য সময় শুধুমাত্র আন্তরিকতা, সত্য, প্রতারণা থেকে মুক্তি, এবং হঠাৎ আক্রমণের ফাঁদ থেকে সুরক্ষা খোঁজে, সেই একই মানুষ এখন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতারণাটি করেঃ এই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতারণাটি করে সে দুর্ভাগ্যের সাথে, যেভাবে সেই বিপরীতধর্মী মানুষটি সুখের সময় তা করে। সে কোন ধরনের দুঃখী এবং পরিবর্তনশীল মনুষ্য চেহারা পরিধান করে না, বরং তার চেহারা যেন একটা গম্ভীর এবং প্রতিসম মুখোশ। সে কাঁদে না; এমনকি তার কন্ঠস্বরেরও পরিবর্তন হয় না। যখন একটা সত্যিকারের ঝড়ো মেঘ তার মাথার উপর গর্জন করে, সে তার আলখাল্লায় নিজেকে জড়িয়ে নেয় এবং ধীর পায়ে সেই মেঘের নিচ থেকে সরে আসে।

______________

পুনশ্চঃ ফ্রেডরিখ নীটশের এই প্রবন্ধ নিয়ে “সত্যের মিথ্যা, মিথ্যার সত্যঃ মানব জ্ঞানের মিথ্যা আখ্যান নিয়ে ফ্রেডরিখ নীটশে” শিরোনামে বোধিচিত্তে একটা আলাপ নেওয়া হয়েছিল, সূত্রধর ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক কাজী রবিউল আলম। আগ্রহীরা সেই আলাপটিও প্রয়োজনবোধে শুনে নিতে পারবেন।

প্রকাশঃ ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২০

Link: https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%A6/%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%95%E0%A6%A4-%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%A4-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A6%A5-%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A6%AF-%E0%A6%93-%E0%A6%AE%E0%A6%A5%E0%A6%AF-%E0%A6%AB%E0%A6%B0%E0%A6%A1%E0%A6%B0%E0%A6%96-%E0%A6%A8%E0%A6%9F%E0%A6%B6

--

--

বোধিচিত্ত

বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার প্রয়াস। A South Asian Platform for Interdisciplinary Studies. Based in Dhaka.