রোম শহরে হাইডেগারের সাথে আমার শেষ দেখা — কার্ল লুভিথ

বোধিচিত্ত
4 min readAug 28, 2021

--

১৯৩৬ সালে যখন আমি রোমে অবস্থান করছিলাম, তখন সেখানের জার্মান-ইতালীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে হোল্ডারলিনের উপরে হাইডেগার একটি লেকচার দেন। এর পরে তিনি আমাদের বাসায় আসেন এবং বাসার জৌলুসহীনতা দেখে পরিষ্কারভাবেই বেশ হতভম্ভ হন…

এর পরের দিন আমি ও আমার স্ত্রী, হাইডেগার, তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানের সাথে ফ্রাস্কাতি ও তুস্কুলাম শহরে বেড়াতে যাই। এই দুই ছেলে যখন ছোট ছিল, আমি ওদের বেশ স্নেহ করতাম। অগ্রাহ্য করা যায়না এমন নানা রকমের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, শেষবারের মত একত্রিত হওয়াতে আমি বেশ আপ্লুতই ছিলাম। এটা ছিল একটা দারুণ বিকেল। এমনকি এই সময়েও ল্যাপেল থেকে তিনি পার্টির পরিচয় চিহ্ন (party insignia) সড়িয়ে ফেলেনি। রোমে থাকাকালীন পুরোটা সময় তিনি এটা পরে ছিলেন। আমার সাথে সময় কাটানোর সময় এই স্বস্তিকা যে আসলে ঠিক উপযুক্ত না সেটা অবধারিত হওয়ার পরেও তিনি এটা পরে ছিলেন।

আমরা ইতালি, ফ্রাইবুর্গ, মারবুর্গ এবং দার্শনিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ করেছিলাম। আলাপকালে তিনি যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ ও মনযোগী ছিলেন। অথচ জার্মানিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার সকল ইঙ্গিতকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী এড়িয়ে গেছেন।

ফিরে আসার সময়, আমি জার্মানির পরিস্থিতি নিয়ে সোজাসাপ্টাভাবেই তাঁর মতামত জানতে চাই। নয়া জুরিখ পত্রিকার বিতর্কের দিকে আমাদের আলোচনাকে নিয়ে যাই। আমি এটাও ব্যাখ্যা করি যে, হাইডেগারের ওপরে বার্থের রাজনৈতিক আক্রমণ অথবা স্টেইগারের পক্ষাবলম্বন কোনোটার সাথেই আমি একমত ছিলাম না। তখন পর্যন্ত আমার মতামত ছিল এই যে, জাতীয় সমাজতন্ত্রের সাথে তাঁর গাঁটছড়ার মূল নিহিত আছে তাঁর দর্শনের সারবত্ত্বায়। হাইডেগার কোনরকম রাখঢাক না রেখেই আমার সাথে একমত হলেন। তিনি আরো যোগ করলেন যে, তাঁর রাজনৈতিক ‘সংশ্লিষ্টতা’র মূলে ছিল তাঁর ‘ঐতিহাসিকতার (historicity)’ ধারণা। হিটলারে তাঁর যে অগাধ আস্থা সে বিষয় নিয়েও কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখলেন না। তিনি দুটি বিষয়কে যথেষ্ট পাত্তা দিতে চাননিঃ খ্রীষ্টিয় চার্চের গুরুত্ব ও অস্ট্রিয়ার সাথে সম্পর্কের প্রতিবন্ধকতা। জাতীয় সমাজতন্ত্রই যে জার্মানির জন্য সঠিক রাস্তা সেই প্রসঙ্গে তিনি আগের মতই প্রত্যয়ী ছিলেন। শুধু একে যথেষ্ট লম্বা সময় পর্যন্ত ‘ধরে থাকতে’ হবে। ‘প্রধান শক্তির’ মূল্যে নিরন্তর ‘সংগঠনের’ ব্যাপারটা তাঁকে বিরক্ত করেছে। এই পুরো তৎপরতার ধ্বংসাত্মক বিপ্লবিপনাকে (Radicalism) ঠাওর করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। একই সাথে এর সকল “strength-through-joy” প্রতিষ্ঠানগুলির পাতি বুঁর্জোয়া চরিত্র ঠাওর করতেও ব্যর্থ হয়েছেন, কেননা তিনি নিজেই ছিলেন এক র‍্যাডিকাল পাতি বুঁর্জোয়া।

আমি বলেছিলাম যে, আমি তাঁর সকল মনোভাবই বুঝি। কিন্ত এটা বুঝিনা, সে কিভাবে একাডেমি অফ জার্মান ল’তে জুলিয়াস স্ট্রাইখারের(১) মত কারো সাথে এক টেবিলে বসে। এর প্রত্যুত্তরে তিনি নীরব ছিলেন। তারপরেই ঈষৎ অস্বস্তির সাথেই তিনি তাঁর স্বপক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করেন… যদি অন্তত কিছু বুদ্ধিমান লোকজন যুক্ত না হত তবে পরিস্থিতি “আরো খারাপ” হত। বিদ্বৎজনাদের প্রতি তেতো বিরক্তিভাব জানিয়ে তিনি এই বলে উপসংহার টানলেন যে, “এই সকল ভদ্দরলোকেরা যদি যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এত শুদ্ধতাবাতিকগ্রস্থ না হতেন তবে পরিস্থিতি ভিন্নরকম হত। কিন্তু তার বদলে এখন আমি সম্পূর্ণরূপে একা।” আমি যখন বললাম স্ট্রাইখারের মত কারো সাথে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে কাউকে বিশেষভাবে শুদ্ধতাবাতিকগ্রস্থ হতে হয়না। এর প্রত্যুত্তরে তিনি বললেনঃ স্ট্রাইখারকে নিয়ে এত শব্দ অপচয় করার কিছু নেই এবং আমি বলেছিলাম যে, আমি তাঁর সকল মনোভাবই বুঝি। কিন্ত এটা বুঝিনা, সে কিভাবে একাডেমি অফ জার্মান ল’তে জুলিয়াস স্ট্রাইখারের(১) মত কারো সাথে এক টেবিলে বসে। এর প্রত্যুত্তরে তিনি নীরব ছিলেন। তারপরেই ঈষৎ অস্বস্তির সাথেই তিনি তাঁর স্বপক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করেন… যদি অন্তত কিছু বুদ্ধিমান লোকজন যুক্ত না হত তবে পরিস্থিতি “আরো খারাপ” হত। বিদ্বৎজনাদের প্রতি তেতো বিরক্তিভাব জানিয়ে তিনি এই বলে উপসংহার টানলেন যে, “এই সকল ভদ্দরলোকেরা যদি যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এত শুদ্ধতাবাতিকগ্রস্থ না হতেন তবে পরিস্থিতি ভিন্নরকম হত। কিন্তু তার বদলে এখন আমি সম্পূর্ণরূপে একা।” আমি যখন বললাম স্ট্রাইখারের মত কারো সাথে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে কাউকে বিশেষভাবে শুদ্ধতাবাতিকগ্রস্থ হতে হয়না। এর প্রত্যুত্তরে তিনি বললেনঃ স্ট্রাইখারকে নিয়ে এত শব্দ অপচয় করার কিছু নেই এবং Der Stürmer পর্নোগ্রাফি বৈ কিছু নয়। তিনি কোনোমতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না কেন হিটলার এই লোককে ছাটাই করে না- যাকে কিনা আবার হাইডেগার যথেষ্ট ভয় পেতেন।

এগুলি খুবই প্রথাগত প্রত্যুত্তর ছিল। কারণ, ভাবনা-চিন্তায় র‍্যাডিকাল হওয়া আর কাজের বেলায় উদাসীন হওয়ার চাইতে জার্মানদের জন্য আর সহজতর কিছু নেই। তাঁদের সমগ্রের ধারণার সাথে আরো সুনিশ্চিতভাবে জড়াজড়ি করে থাকা ও “ব্যক্তির” কাছ থেকে “Matters of fact”কে আলাদা করার জন্য তারা কোন না কোনভাবে সকল individual Fakta কে এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। সত্যি বললে, ১৯৩৮ সালে(২) “পর্নোগ্রাফির” কার্যক্রম (উদাহরণস্বরূপ, কে এড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। সত্যি বললে, ১৯৩৮ সালে(২) “পর্নোগ্রাফির” কার্যক্রম (উদাহরণস্বরূপ, Der Stürmer এর মত ইহূদীবিদ্বেষী প্রকাশনা যা ধারণ করে) পূর্ণতা পায় ও জার্মান বাস্তবাতায় পরিণত হয়। এবং এটা কেউই অস্বীকার করতে পারবেনা যে স্ট্রাইখার ও হিটলার এই বিষয়ে একমত ছিলেন।

১৯৩৮ সালে, ফ্রাইবুর্গে হুসার্ল মারা যান। ঘরোয়া অথবা জনপরিসরে, লিখিত অথবা মৌখিকভাবে কোনপ্রকারের স্মৃতিচারণ বা সমবেদনায় একটা শব্দও ব্যয় না করার মাধ্যমে হাইডেগার তাঁর “শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব”(১৯২৭ সালে প্রকাশিত Being and Time এর উৎসর্গ পাতায় হুসার্লকে এইভাবেই শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের কথা বলেছিলেন) প্রমাণ করেছেন।

______________

ইংরেজি অনুবাদকের পাদটীকাঃ

১। স্ট্রাইখার ছিলেন একজন নাৎসি প্রপাগান্ডিস্ট ও Der Stürmer নামের জনপ্রিয় ইহূদীবিদ্বেষী পত্রিকার সম্পাদক।

২। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে লুভিথের (Karl Löwith) এই ভাবনাচিন্তা ১৯৪০ সাল থেকে দানা বাঁধে। ১৯৩৮ সালের যে ইশারা তা নিঃসন্দেহে Kristallnacht এর ইংগিত যখন নাৎসিদের ইহূদীবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা রক্তাক্ত ও বিভৎস এক বাস্তবতায় রূপ নেয়।

হদিসঃ কার্ল লুভিথের Mein Leben in Deutschland vor und nach 1933 (Stuttgart: Metzler Verlag, 1986; 56–58) লেখার রিচার্ড ভোলিনকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনূদিত।

প্রথম প্রকাশঃ ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৯

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/433027494336189/

https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%A6/%E0%A6%B0%E0%A6%AE-%E0%A6%B6%E0%A6%B9%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%87%E0%A6%A1%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%A5-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%B7-%E0%A6%A6%E0%A6%96-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%B2-%E0%A6%B2%E0%A6%AD%E0%A6%A5

--

--

বোধিচিত্ত

বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার প্রয়াস। A South Asian Platform for Interdisciplinary Studies. Based in Dhaka.