শ্রাফা, ভিটগেনস্টাইন এবং গ্রামশি— অমর্ত্য সেন

বোধিচিত্ত
38 min readAug 28, 2021

--

[প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের Sraffa, Wittgenstein and Gramsci শীর্ষক প্রবন্ধটি জার্নাল অব ইকোনমিক লিটারেচার-এর ২০০৩ সনের ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধটি যৌথভাবে তর্জমা করেছেন নাসরিন সুলতানা সুপ্তি ও মোস্তফা রাফি। অনুবাদকদ্বয় উভয়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী।]

১. ভূমিকা

চলতি বছরের [২০০৩] ফেব্রুয়ারিতে Accademia Nationale dei Lincei পিয়ের শ্রাফার বিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে রোমে একটি বড় কনফারেন্সের আয়োজন করে। তাঁরা আসলে উৎযাপন করছিলেন অসাধারণ এক বিদ্বজ্জনের স্মৃতি, যার প্রকাশিত কাজ খুবই কম কিন্তু সমসাময়িক অর্থশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র ও সমাজবিদ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। শ্রাফার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতির তত্ত্বের ক্ষেত্রে কতগুলো নতুন উন্মোচন এবং সেইসাথে রাজনৈতিক অর্থনীতির ইতিহাসের একটি পুনর্মূল্যায়ন (যা শুরু হয়েছে ডেভিড রিকার্ডোর কাজ ধরে)। সমসাময়িক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্থান বা দিক-পরিবর্তনের একটি আনয়নেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে; যেমন ট্রাকটেটাস (ভিটগেনস্টাইন, Tractutatus Logico-Philosophicus : ১৯২১)-এর লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের আদি অবস্থান হতে পরবর্তীকালে ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশন্স (ভিটগেনস্টাইন, Philosophical Investigations : ১৯৫৪)-এ গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা।

“অর্থনীতিবিদ শ্রাফা”কে সবসময় তাঁর অন্য সকল ভূমিকা হতে আলাদা করে রাখা হয়েছে। সেটা অংশত এই কারণে যে, শ্রাফা পেশাগতভাবে একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন এবং একারণেও যে তাঁর অর্থনীতির অবদানগুলোকে — অন্তত ভাসাভাসাভাবে — তাঁর দর্শনগত ধারণাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। যদিও ডেভিড রিকার্ডোর কাজের সম্পাদনার বাইরে তিনি অল্পসংখ্যক প্রবন্ধ এবং একটি মাত্র বই প্রকাশ করেছেন, তবুও শ্রাফা অর্থশাস্ত্রে বহুল-উদ্ধৃত লেখক। অর্থনীতিতে তাঁর অবদানগুলো — বিশেষ করে তাঁর বইটি, দ্রব্যের নিমিত্তে দ্রব্যের উৎপাদনঃ অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বের একটি সমালোচনার গৌড়চন্দ্রিকা (শ্রাফা, Production of commodities by means of commodities: prelude to a critique of Economic Theory : ১৯৬০) — অর্থশাস্ত্রের প্রধান বাদানুবাদগুলো তৈরি করেছে। শ্রাফার কাজগুলো অর্থনীতির তত্ত্বে একটি সারগর্ভপূর্ণ চিন্তার ধারা সূচনা করেছে। তারপরও একদল অর্থনীতিবিদ দাবি করেছেন, তাঁর লেখায় তেমন সারগর্ভ কিছু নেই; এবং একইসাথে আরেকদল (উল্লেখযোগ্যভাবে বললে, পল স্যামুয়েলসন) দাবি করেছেন, শ্রাফা অংশত সারপূর্ণ এবং অংশত একদম ভুলভাল।

“অর্থনীতিবিদ শ্রাফা”কে আলাদাভাবে নিরীক্ষণের ঝোঁক নিশ্চিতভাবে অনেক শক্তিশালী। তা সত্ত্বেও, সেই সঙ্গে শ্রাফার ভিন্ন ভিন্ন অবদানগুলোকে একসাথে মিলিয়ে দেখার মধ্যেও অনেকখানি অর্থবোধকতা রয়েছে। দর্শনশাস্ত্রগত চিন্তার ইতিহাসে [তাঁর ভূমিকা] কোন অংশে কম গুরুত্ব বহন করেনা, শ্রাফার সাথে ভিটগেনস্টাইনের (যাকে শ্রাফা প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিলেন) মিথস্ক্রিয়াকে গুরুত্বের সাথে পুনঃনিরীক্ষণ করলে এক্ষেত্রে তাৎপর্য্য মিলতে পারে। শ্রাফার সাথে আন্তোনিও গ্রামশির (ইতালীয় মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক, শ্রাফার উপর যার প্রবল প্রভাব রয়েছে) সম্পর্কের আলোকে এই পুনঃনিরীক্ষণ করতে হবে। বস্তুত, এই দ্বৈত সম্পর্ক “প্রথমদিককার [ট্রাকটেটাসের] ভিটগেনস্টাইন”-এর “পরবর্তীকালের [উত্তর-পর্বের] ভিটগেনস্টাইন”-এ রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য “গ্রামশি সংযোগ”কে উন্মোচিত করার সুযোগও তৈরি করে দেয়।

২. ভিটগেনস্টাইন ও শ্রাফা

বার্ট্রান্ড রাসেলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ১৯১৩ সালে ক্যামব্রিজ ছাড়ার পরে, লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে [আবার] ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ফিরে আসেন। ভিটগেনস্টাইনের সেই ফিরে আসাটা বড় ঘটনা ছিল, যেহেতু ততদিনে তিনি একজন প্রতিভাবান দার্শনিক হিসেবে খ্যাত হয়ে উঠেছেন। জন মেয়নার্ড কেইনস তাঁর স্ত্রী লিডিয়া লোপোকোভা’কে লিখেনঃ

“যাক, ঈশ্বর এসে গেছেন। পাঁচটা পনেরোর ট্রেনে তাঁর সাথে দেখা হয়েছে আমার।”

পিয়ের শ্রাফাও (যিনি ভিটগেনস্টাইনকে আগে চিনতেন না) ইতালি থেকে ক্যামব্রিজে এসেছেন ভিটগেনস্টাইনের ফিরে আসার কিছুকাল আগেই। যদিও শ্রাফা সেসময়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সী ছিলেন (তিনি ১৮৯৮ সালের ৫ই আগস্ট তুরিনে জন্মগ্রহণ করেন), তাও ইতিমধ্যেই তিনি ব্রিটেন ও ইতালিতে একজন অত্যন্ত মৌলিক অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯২০ সালের শেষের দিকে, মুদ্রাবিষয়ক অর্থশাস্ত্রের উপর একটি অভিসন্দর্ভ লিখে তিনি “ইউনিভার্সিটি অব তুরিন” থেকে একটি গবেষণা ডিগ্রি (testi de Lawnew) অর্জন করেন। কিন্তু তাঁকে ইতালি ও ব্রিটেনে একজন প্রধান খ্যাতিমান ব্যক্তি করে তুলেছিল, মূল্যতত্ত্বের ভিত্তিসমূহের উপর লিখা একটি প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধটি ১৯২৫ সালে Anmoli di Economia (মিলানভিত্তিক একটি সাময়িকী)-তে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধটিতে শ্রাফা দেখিয়েছেন যে, আলফ্রেড মার্শাল (তখনকার[সময়ের]-প্রভাবশালী ক্যামব্রিজ ঘরানা’র প্রধান) কর্তৃক বিকশিত চলমান মূল্যতত্ত্বের (price theory) ভিত্তিসমূহ ছিল সংশোধন-অযোগ্য-গোছের-ত্রুটিপূর্ণ। এই প্রবন্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচিত অংশ পরের বছর ইকোনমিক জার্নালে (শ্রাফা, ১৯২৬) ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় এবং এটা অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারী ছিল।

শ্রাফার সুগভীর রাজনৈতিক আগ্রহ এবং অঙ্গীকারও ছিল। তিনি সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার্থীদের দলে সক্রিয় ছিলেন। ১৯১৯ সালে, আন্তোনিও গ্রামশি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত বামপন্থী সাময়িকী “লা’ অর্দিনো ন্যুয়োভো”র (L’ordine Nuovo, যা পরবর্তীতে ফ্যাসিবাদী সরকার নিষিদ্ধ করে) সম্পাদকীয়’র কর্মীদলে যোগদান করেন। বস্তুত, ১৯২৭ সালে শ্রাফা যখন ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হন, সেসময়ে তিনি ইতালির বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে একজন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন এবং ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও গ্রামশি পরিচালিত “ইতালীয় কম্যুনিস্ট পার্টি”র সদস্য না হলেও কাছাকাছি ছিলেন। যখন শ্রাফা ১৯২৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেরুজা’য় (University of Perugia) প্রভাষক পদ (এবং ১৯২৬ সালে সার্দিনিয়ার ক্যালিয়ারি [Cagliari]-তে অধ্যাপক পদ) লাভ করেন, তখন ইতালিতে ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন তীব্রতর হওয়ায় তিনি ঠিক করলেন ব্রিটেনে হিজরত করবেন।

ইতিমধ্যে ১৯২২ সালে পিয়ের শ্রাফার বাবা অ্যাঞ্জেলো শ্রাফা (যিনি ব্যকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের [Bucconi University] রেক্টর ছিলেন), মুসোলিনীর কাছ থেকে দুটি টেলিগ্রাম পান। টেলিগ্রামে দাবি করা হয় “ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানে’’ প্রকাশিত (এটা সম্ভব হয়, জন মেয়নার্ড কেইনসের আমন্ত্রণে যোগ দেওয়ায় ফলে) ইতালীয় আর্থিক নীতিমালার যে সমালোচনামূলক বিবরণী ছিল তা পিয়ের শ্রাফাকে প্রত্যাহার করতে হবে। মুসোলিনীর অভিযোগ ছিল বিবরণীটি “অনাস্থা ছড়াচ্ছিল” এবং “সত্যিকার ও বাস্তবিকই অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা”। সাহসী ও দৃঢ়চেতা বিদ্বৎজন অ্যাঞ্জেলো শ্রাফা উত্তরে বললেন যে, প্রবন্ধটি শুধুমাত্র “জানা তথ্য” লিপিবদ্ধ করেছে এবং এতে প্রত্যাহার করে নেয়ার মত কিছু নেই। পরবর্তী বছরগুলোতে পিয়ের শ্রাফাকে ইতালীয় সরকারের সাথে বিভিন্ন বিবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১৯২৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি জন মেয়নার্ড কেইনসের কাছ থেকে আমন্ত্রণ সম্বলিত একটি চিঠি পান। সে বছরই (সেপ্টেম্বরে) তিনি ক্যামব্রিজে চলে যান। ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে যখন ভিটগেনস্টাইন ক্যামব্রিজে ফিরলেন, ততদিনে ক্যামব্রিজে কুশলী বিদ্বৎজনদের একজন হিসেবে পিয়ের শ্রাফা তুমুল খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন।

শ্রাফার যে প্রভাব ভিটগেনস্টাইনের চিন্তার উপর ছিল তা তৈরী হয়েছে তাঁদের মধ্যকার ধারাবাহিক আলাপচারিতায়। প্রশ্ন আসে, সেই প্রভাব কেমন আকার ধারণ করেছিল? সেই মাত্রাটা এমনই ছিল যে, ১৯২৯ পরবর্তী বছরগুলোয় ভিটগেনস্টাইনের দর্শনগত অভিমুখ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল; সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রস্থিত ভিত্তিই ছিল শ্রাফার সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা। তাঁর প্রথম দিককার কাজগুলোয় (বিশেষ করে ট্রাকটেটাস গ্রন্থে), ভিটগেনস্টাইন একটি পথ ধরে এগোন যাকে মাঝেমধ্যে “অর্থের ছবিতত্ত্ব বা চিত্রতত্ত্ব (picture theory of meaning)” নামে অভিহিত করা হয়। এই তত্ত্বে ঘটনাবলীর অবস্থা (state of affairs) প্রকাশকারী একটি বাক্যকে দেখা হয় এর এক ধরনের ছবি বা চিত্ররূপ হিসেবে। ঘটনাবলীর যে অবস্থা তার গঠনকে প্রতিবিম্বিত করার মাধ্যমে এটি বর্ণনার কাজ করে। এখানে একটি জোরারোপ রয়েছে — কিছুটা অতিসরলীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায় যে — একটা বিবৃতি (statement) এবং এটি যা বর্ণনা করে এ’দুয়ের যৌক্তিক গঠন একই হবে। শ্রাফার কাছে এই দর্শনগত অবস্থানকে মোটের উপর ভ্রান্ত মনে হলো এবং ভিটগেনস্টাইনকে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যুক্তিসহকারে বললেন।

একটি সুখ্যাত গল্প থেকে জানা যায়, ভিটগেনস্টাইনের ধারণার উত্তর করেছিলেন শ্রাফা নিজের চিবুকে আঙ্গুলের ডগাগুলো ঝাড়া দিয়ে — যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে সংশয়বাদের নেপোলিটান অঙ্গভঙ্গি (Neapolitan gesture) হিসেবে ধরা হয়, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে সেই যৌক্তিক গঠনটা কী?” শ্রাফাকে পরবর্তীতে ভালোভাবে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার — প্রথমত একজন ছাত্র হিসেবে ও পরবর্তীতে ক্যামব্রিজে ট্রিনিটি কলেজে সহকর্মী হিসেবে। এই গল্প নিয়ে শ্রাফা জোর দিয়ে বলেন যে, যদি এটি সম্পূর্ণরূপে অপ্রামাণিক (“আমি অন্তত এরকম বিশেষ কোন ঘটনা মনে করতে পারিনা”) না’ও হয়, তবুও প্রকৃত ঘটনার তাৎপর্য সমেত প্রচলিত একটি আখ্যান হিসেবে বেশি মানানসই। “প্রকৃতপক্ষে, ভিটগেনস্টাইনের সাথে প্রায়শই অনেক তর্কবিতর্ক চলত এবং তা এতটাই বেশি পরিমাণে যে আমার আঙুলের ডগাকে আলাদা করে কিছু বলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ত না।“ কিন্তু গল্পটি ট্রাকটেটাস-এ যে দর্শনগত রূপরেখা দেখানো হয়েছে তার প্রতি শ্রাফার সংশয়বাদের প্রকৃতিকে পষ্ট ব্যাখ্যা করে এবং বিশেষ করে সামাজিক প্রচলনগুলো কীভাবে আমাদের অঙ্গভঙ্গি ও বাচনভঙ্গির অর্থবোধকতায় অবদান রাখে তা’ও দেখায়।

শ্রাফার সাথে ভিটগেনস্টাইনের যে আলাপচারিতাগুলো হয়েছিল তা স্পষ্টভাবে ভিটগেনস্টাইনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভিটগেনস্টাইন পরবর্তীতে বিশিষ্ট ফিনিশ দার্শনিক হেনরিক ফন রাইট’কে বলবেন এভাবে যে, সেই আলাপচারিতাগুলো তাঁকে এমন একটা অনুভূতি দিয়েছিল “যেন একটি গাছের সব শাখা-প্রশাখাগুলো কেটে নেয়া হয়েছে।“ প্রচলিতভাবে ভিটগেনস্টাইনের কাজগুলোকে “প্রথমদিককার [ট্রাকটেটাসের] ভিটগেনস্টাইন” ও “পরবর্তীকালের বা উত্তর-পর্বের ভিটগেনস্টাইন” — এ দুটি ভাগে ভাগ করা হয় এবং ১৯২৯ সালটাই ছিল সেই দুটি দশার মধ্যবর্তী বিভাজন রেখা। বস্তুত, শ্রাফাই একমাত্র ছিলেন না — যাদের সমালোচনা নিয়ে ভিটগেনস্টাইনকে ভাবতে হয়েছিল। ক্যামব্রিজে গণিতশাস্ত্রে পরাক্রমশালী তারুণ্য ফ্রাঙ্ক রামজে ছিলেন আরেকজন। ভিটগেনস্টাইন (১৯৫৩, p. xe) রামজে’কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, কিন্তু একইসাথে লিপিবদ্ধ করেন যে তিনি “এমনকি আরও বেশি ঋণী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, মিস্টার পি. শ্রাফার সমালোচনার প্রতি যিনি আমার চিন্তাগুলোর উপর অনেক বছর ধরে অবিরাম যৌক্তিক বিচার জারি রেখেছিলেন”। সেই সাথে যোগ করেন যে, তিনি “বইটির সবচেয়ে আনুষঙ্গিক ধারণাগুলোর পেছনের এই প্রেরণার জন্য ঋণী।”

ভিটগেনস্টাইন একজন বন্ধুকে (Rush Rhess, আরেকজন ক্যামব্রিজের দার্শনিক) বলেন যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি শ্রাফা তাঁকে শিখিয়েছিলেন তা হলো — দর্শনগত সমস্যাগুলোকে “নৃতাত্ত্বিক পথা বা ভঙ্গিমা (the anthropological way)”য় দেখা। শ্রাফা এবং ফ্রয়েডের প্রভাব নিয়ে তাঁর অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণে ব্রায়ান ম্যাকগিনিস (১৯৮২) ভিটগেনস্টাইনের উপর “বিষয়াদির প্রতি নৃতাত্ত্বিক অথবা জাতিতাত্ত্বিক (ethnological) দৃষ্টিভঙ্গি (যা অর্থনীতিবিদ শ্রাফার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন)”-এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। ট্রাকটেটাস যেখানে ভাষাকে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করে, সেখানে ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশন্স নিয়ম ও প্রচলনের (যেগুলো বাচনভঙ্গিসমূহকে বিশেষ অর্থবোধকতা প্রদান করে) উপর জোর দেয়। পরিপ্রেক্ষিতের সাথে “সাধারণ ভাষাদর্শন (Ordinary language philosophy)” নামে পরিচিত ধারণার যোগাযোগও পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।

নেপোলিটান ভঙ্গিতে আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চিবুকে ঝাড়া দেওয়ার (এমনকি তুরিনে জন্মগ্রহণকারী, পিসা থেকে আসা একটি তুসকান বালকও যদি এটা করে) মাধ্যমে যেভাবে সংশয় জ্ঞাপন করা হয় তা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও প্রচলনের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়, যেগুলো নেপোলিটান জগতে প্রকৃতপক্ষে “জীবনের প্রবাহ”। লোকজন কিভাবে ভাষা এবং শব্দাবলী ও অঙ্গভঙ্গির অর্থবোধকতার ব্যবহার শেখে তা ব্যাখ্যা করতে ভিটগেনস্টাইন (১৯৫৩, P. 5e) “ভাষা-খেলা” নামক শব্দসমষ্টি ব্যবহার করেন। যদিও পরিশেষে বলা যায়, যেকোন প্রকৃত ভাষাতেই — “ভাষা-খেলা (language-game)” হিসেবে যা দেখা যায় তার চেয়ে — আরও অনেকখানি বেশি কিছু রয়েছে।

শব্দ ব্যবহারের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে আমরা ভাবতে পারি… সেই খেলাগুলো হিসেবে যার মাধ্যমে বাচ্চারা তাঁদের স্থানীয় ভাষা শেখে। আমি এই খেলাগুলোকে “ভাষা-খেলা” বলবো এবং একটি ভাষার খেলা হিসেবে মাঝেমধ্যে আদি ভাষার ব্যাপারে কথা বলব।

৩. অনিচ্ছা ও ফাটল

তবে, শ্রাফা কী আমাদের সময়কার অন্যতম প্রধান (তর্কসাপেক্ষ) দার্শনিকের (সেই “ঈশ্বর” যার সাথে কেইনসের পাঁচটা পনেরোর ট্রেনে সাক্ষাৎ হয়েছিল) উপর তাঁর নিজের ধ্যান-ধারণার প্রভাব লক্ষ্য করে শিহরিত হয়েছিলেন? এবং সেই অতিগুরুত্বপূর্ণ চিন্তাগুলোর সাথে কেনই-বা শ্রাফার নাম প্রথমেই হাজির হয়? ১৯৫৮ ও ১৯৬৩ এর মাঝামাঝি সময়গুলোয় যখন তাঁর সাথে আলাপের সুযোগ হয়, তখন বিকালবেলার হাঁটাহাঁটির সময় একাধিকবার তাকে প্রশ্নগুলো করেছিলাম। আর কিছুটা বিস্ময়কর উত্তর পেলাম। না, তিনি তেমন বিশেষভাবে রোমাঞ্চিত হননি যেহেতু তিনি সূত্র ধরে যাচ্ছিলেন তা “বরং সুস্পষ্ট বা অবশ্যম্ভাবী ছিল”। না, তিনি যথাযথ নির্ভূলভাবে জানতেন না কী-করে তিনি সেই তর্কে পৌছেছেন, যেহেতু — আবারও বলি — যে সূত্র তিনি ধরেছেন তা “বরং সুস্পষ্ট বা অবশ্যম্ভাবী” ছিল।

শ্রাফা ভিটগেনস্টাইনকে খুব ভালোবাসতেন এবং বিপুলভাবে প্রশংসা করতেন।কিন্তু এটি পরিষ্কার ছিল যে, প্রতিভাবান দার্শনিকের সাথে নিরন্তর সংলাপ বা বাক-বিনিময়ের ফলপ্রসূতা সম্পর্কে প্রতীত বা কনভিন্সড ছিলেন না। ভিটগেনস্টাইনের মৃত্যুর অল্পসময় বাদে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আমি যখন ছাত্র হিসেবে ট্রিনিটিতে পৌঁছাই, তখন এ দুজনের মধ্যকার ফাটলের ব্যাপারে কিছুটা সচেতন হই। আমার প্রশ্নগুলোর উত্তরে শ্রাফা অনেকটা অনাগ্রহী থাকতেন, আদতে যা ঘটেছিল তা নিয়ে বলার ব্যাপারে। “আমাদের নিয়মিত আলাপচারিতা আমাকে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল — কেননা আমি কিছুটা বিরক্ত হতাম”, এই ছিল ঘটনার বিপরীতে আমার পাওয়া সবচেয়ে কাছাকাছি উত্তর। ঘটনাবলী যেভাবেই হউক, রে মঙ্ক (১৯৯১)-এর বর্ণনায় আরও বিস্তারিত উঠে এসেছিল তাঁর লেখা ভিটগেনস্টাইনের জীবনী’তে (পৃ-৪৮৭):

১৯৪৬ সালের মে মাসে পিয়ের শ্রাফা সিদ্ধান্ত নেন তিনি ভিটগেনস্টাইনের সাথে আলাপচারিতায় আর ইচ্ছুক নন, এই বলে যে ভিটগেনস্টাইন যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে চান তাতে শ্রাফা আর বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে পারবেন না। এটি ভিটগেনস্টাইনের কাছে একটি বড়সড় চোট হিসেবে দেখা দেয়। তিনি শ্রাফার নিকট আকুতি জানান তাঁদের সাপ্তাহিক আলাপচারিতা চালিয়ে নিতে চেয়ে — এমনকি দর্শনগত বিষয়বস্তুর বাইরের কথাবার্তার মাধ্যমে হলেও। “আমি যেকোন কিছু নিয়ে কথা বলব” তিনি বলেছিলেন শ্রাফাকে। “হ্যাঁ, কিন্তু তোমার ধরনে” শ্রাফা উত্তরে বলেছিলেন।

শ্রাফা-ভিটগেনস্টাইন সম্পর্কে অনেক গোলমেলে ব্যাপার ছিল। কীভাবে শ্রাফার মত একজন — যিনি সংলাপ ও যুক্তিতর্ক ভালোবাসতেন — তিনিই বিংশ শতাব্দীর সূক্ষ্মতম মানসের একজনের সঙ্গে আলাপে এত অনাগ্রহী হয়ে উঠলেন? এমনকি শুরুতে কীভাবে যেই আলাপচারিতাগুলো ভিটগেনস্টাইনের জন্য পরিষ্কারভাবে এত আনুষঙ্গিক ছিল যা তাঁকে “সকল শাখা-প্রশাখা কেটে নেয়া একটা গাছের মত” অনুভব করিয়েছিল সেগুলোই তুসকানী অর্থনীতিবিদের নিকট “এটাই বরং হবার কথা” হয়ে দেখা দিলো? আমি সন্দিগ্ধ আদৌ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা কখনো জানতে পারব কিনা। পরবর্তীকালের ফাটল নিয়ে কথা বলতে গেলে, মনে হয় শ্রাফা সরে গিয়েছিলেন ভিটগেনস্টাইনের কর্তৃত্বব্যঞ্জক অভ্যাসের কারণে — যা ব্যঙ্গচিত্রিত হয়েছিল জুলিয়ান বেল (ক্লাইভ বেল-এর পুত্র) নামে একজন ছাত্রের কবিতায়ঃ

কে কবে দেখেছ — কোন একটা ইস্যুতে

সবজান্তা শমসেরের মতো হাঁকডাক পাড়া থেকে লুডভিগ বিরত থেকেছে?

সকল জমায়েতে সে হাঁক ছাড়ে আমাদের ছাপিয়ে,

এবং আমাদের কথাগুলো বন্ধ করে, নিজেরটাই শুধু আওড়িয়ে।

ভিটগেনস্টাইনের রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় সরলতার কারণেও শ্রাফা অনেকখানি তিক্তবিরক্ত হয়ে থাকতে পারেন। ঠিক যখন হিটলার তাঁর বিজয় চালিয়ে যাচ্ছিলো শহরজুড়ে, ১৯৩৮ সালে ভিয়েনা যাওয়া থেকে ভিটগেনস্টাইনকে (তাঁর গঠনশীল স্পষ্টবাদিতা ও সেই সাথে ইহুদী বংশ পরিচয়ও থাকার কারণে) আটকাতে হয়েছিল শ্রাফার। যদিও দুজনেই বাম ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, শ্রাফা (একজন পোক্ত রাজনৈতিক বাস্তববাদী হিসেবে) ভিটগেনস্টাইনের সামাজিক বিশ্বাসগুলোর বিষম খামখেয়ালিপনায় খুব অল্পই সদগুণ দেখতে পেতেন। ভিটগেনস্টাইনের সামাজিক বিশ্বাসে সমবেত ছিল কঠোর পরিশ্রমের অ-সয়ংক্রীয় বা কায়িক (manual) শ্রমময় জীবনের জন্য কল্পনা-রঙিন তীব্র আকাঙ্খা এবং সেইসাথে এই আশা যে কম্যুনিস্ট বিপ্লব বিজ্ঞানের (যাকে ভিটগেনস্টাইন সমসাময়িক জীবনে উপদ্রবকারী হিসেবে দেখতেন) উপাসনাকে প্রত্যাখানের পথে নিয়ে যাবে।

যাইহোক, তবুও প্রশ্ন থেকে যায় শ্রাফা কেন একেবারে শুরুর দিকেও (১৯২৯ সালে এবং তারপরে) ভিটগেনস্টাইনের সাথে আলাপচারিতার গভীরতা ও মাহাত্ম্য নিয়ে এত গম্ভীর ছিলেন, এবং কেনই’বা যে ধারণাগুলো ভিটগেনস্টাইনকে এত প্রভাবিত করে সেগুলো শ্রাফার নিকট বরং সোজাসাপ্টা মনে হবে। শ্রাফা নিজে এ বিষয়ে তেমন কোনকিছু প্রকাশ করেননি। কিন্তু বিবেচনাযোগ্য অনেক প্রমাণাদি আছে যে, ভিটগেনস্টাইনের কাছে যা নতুন জ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল তা ইতালিতে — যে বুদ্ধিবৃত্তিক সংসর্গের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন শ্রাফা ও গ্রামশিই উভয়েই সেখানে [এটি] — একটি সাধারণ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। ঠিক এটা নিয়েই আমার পরবর্তী আলোচনা।

৪. গ্রামশি সংযোগ

আন্তোনিও গ্রামশি তাঁর দার্শনিক ধ্যান-ধারণাগুলো লেখার ব্যাপারে শ্রাফার চেয়ে কম মৌন ছিলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদানের জন্য প্রস্তাব করে যখন জন মেয়নার্ড কেইনস ১৯২৭ সালের জানুয়ারীতে শ্রাফার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, সে সময়টায় (সঠিকভাবে বলতে গেলে ৮ই নভেম্বর, ১৯২৬) গ্রামশি গ্রেফতার হন। মিলানের কারাবাসে কতকগুলো যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার পর ১৯২৮ সালের গ্রীষ্মকালে রোমে গ্রামশিকে একটি বিচারের সম্মুখীন হতে হয়, আরও অনেকজন রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে। গ্রামশি বিশ বছরের জন্য জেলে থাকবার দণ্ডপ্রাপ্ত হন (“বিশ বছরের জন্য আমাদেরকে এই মস্তিষ্কটির কাজ করা বন্ধ রাখতে হবে” — সরকারপক্ষের উকিল এক বিবৃতিতে বলেন এবং নিজের কিছু খ্যাতি যোগাড় করেন)। “বারি (Bari)” থেকে বিশ মাইল দূরে তুরি (Turi)-তে একটি কারাগারে গ্রামশিকে পাঠানো হয়। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে গ্রামশি প্রবন্ধ ও নোটস লেখায় ব্যস্ত হয়ে যান — যেগুলো পরবর্তীতে তাঁর প্রিজন নোটবুক্‌স (গ্রামশি: ১৯৭১, ১৯৭৪) হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠবে।

সেসব নোটগুলো আমাদের সামনে গ্রামশি ও তাঁর সংসর্গে থাকা ব্যক্তিগণ কী নিয়ে আগ্রহী ছিলেন যে বিষয়ে রীতিমত ভালো বোঝাপড়া হাজির করে। শ্রাফা খুবই চাইতেন গ্রামশি তাঁর চিন্তা-ভাবনাগুলো লিখে রাখবেন এবং গ্রামশিকে সে ব্যাপারে তিনি সাহায্য করবেন। শ্রাফা গ্রামশির নামে মিলানে একটি বইয়ের দোকানের (Sperline and Kupfer) সাথে একটি আনলিমিটেড হিসাব খুলেন, যার ব্যয় শ্রাফা মিটিয়ে দেন। আগেই উল্লেখিত হয়েছিল, গ্রামশি পরিচালিত লা’ অর্দিনো ন্যুয়োভো’র সম্পাদকীয় কর্মীদলের অংশ ছিলেন শ্রাফা। শ্রাফা সেই দলে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু গ্রামশির সাথে পরিচয় এটার আগে থেকেই ছিল এবং ১৯১৯ সাল থেকেই তিনি লা’অর্দিনো ন্যুয়োভো‘তে লেখালেখি করেন (মূলত ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় রচিত লেখার তর্জমা করতেন)। বিশিষ্ট এই সাময়িকীতে কাজ করার সুবাদে শ্রাফা ও গ্রামশি আগের তুলনায় আরও ঘনিষ্ঠ হন, সেই বছরগুলোতে সুগভীর আলোচনা হয় তাঁদের দুজনের মধ্যে।যদিও সময়ে সময়ে দুজন একে অপরের ধারণার সাথে অসম্মত হতেন। উদাহরণস্বরূপঃ ১৯২৪ সালে যখন শ্রাফা দলের কর্মনীতি নিয়ে সমালোচনা করেন (কম্যুনিস্ট পার্টি “একটি শোচনীয় ভূল করে যখন তারা এরকম প্রকাশ করে যে তারা বিপক্ষীয় আন্দোলন জোটে অন্তর্ঘাত তৈরি করছে”), তখনও তাঁদের মধ্যকার পারস্পরিক যোগাযোগের যে সুগভীর ফলপ্রসূতা সেসম্পর্কে সন্দেহ রাখা যায়না।

যেহেতু প্রিজন নোটবুক্‌স ছিল অনেকাংশেই গ্রামশির বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনার ধারাবাহিকতা এবং তাঁর বন্ধুদের মধ্যে চর্চিত ধ্যান-ধারণাগুলোর প্রতিফলন, তাই গ্রামশির লেখা নোটগুলো কীভাবে শ্রাফা ও ভিটগেনস্টাইনের মধ্যকার আলাপচারিতার বিষয়বস্তুর (সেইসঙ্গে নিয়ম ও প্রচলনের ভূমিকা এবং “সাধারণ ভাষাদর্শন” হিসেবে পরিচিত ধারণায় গিয়ে পৌঁছানোর) সঙ্গে সম্পর্কিত তা দেখতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে। “দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন (the study of philosophy)” নামে একটি প্রবন্ধে গ্রামশি আলোচনা করেন “রেফারেন্স বা দোহাইয়ের কিছু প্রাথমিক সূত্রাবলী”, যেখানে একটি জোরালো দাবী র‍য়েছে যে, “দর্শনশাস্ত্র একটি অদ্ভূত এবং দুঃসাধ্য বস্তু কেননা এটি পেশাদারী ও নিয়মতান্ত্রিক দার্শনিকদের একটি বিশেষ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম — এই বহুল প্রচলিত কুসংস্কারকে ধ্বংস করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।” গ্রামশি দাবি করেন, বরং “সকলের প্রতি খাটে এমন ‘স্বতঃস্ফূর্ত দর্শন (spontaneous philosophy)’-এর সীমাবদ্ধতা এবং বৈশিষ্ট্যাবলী সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে, প্রথমেই দেখাতে হবে যে — সকল মানুষই ‘দার্শনিক’।“

তাহলে, “স্বতঃস্ফূর্ত দর্শন” আবার কী বস্তু? এই শিরোনামের অধীনে প্রথমেই গ্রামশি যা লিপিবদ্ধ করেন তা হল “ভাষা নিজেই কতগুলো নির্ধারিত মত ও ধারণার সামষ্টিকতা এবং বিষয়বস্তু বিবর্জিত ব্যাকরণসিদ্ধ শব্দাবলী তো কেবল নয়।” নিয়ম ও প্রথা বা প্রচলনের ভূমিকা — ভিটগেনস্টাইন যাকে “ভাষা-খেলা” এবং যাকে “নৃতাত্ত্বিক ভঙ্গিমা” (যেটাতে শ্রাফা ভিটগেনস্টাইনের চেয়েও চ্যাম্পিয়ান) বলেছেন তাঁর প্রাসঙ্গিকতা — এ সবই অত্যন্ত বৃহৎ পরিসরে প্রিজন নোটবুক্‌সে (গ্রামশি: ১৯৭৫, পৃ. ৩২৪) উঠে এসেছে এইভাবেঃ

জগত সম্বন্ধে ধারণা অর্জনের ক্ষেত্রে একজন সবসময় একটা বিশেষ দলভূক্ত হিসেবে থাকে যেখানে সকল সামাজিক উপাদানগুলো একই চিন্তা পদ্ধতি ও ভঙ্গিমা ভাগাভাগি করে নেয়। আমরা সকলেই কোন না কোন প্রথানুবর্তিতার প্রথানুবর্তী, সবসময়ই গণ-এর-মাঝের-মানুষ অর্থাৎ সামষ্টিক মানুষ।

ভাষাতাত্ত্বিক প্রচলনের ভূমিকা গ্রামশির আলোচনায় বহুভাবে চিত্রিত হয়েছে। তার একটি উদাহরণ (গ্রামশি ১৯৭৫, পৃ-৪৪৭) এ’রকমঃ

বার্ট্টান্ড রাসেলের একটি ছোট বইতে (দর্শনশাস্ত্রের সমস্যাবলী) থাকা একটি উদাহরণ বিবেচনা করা যাক। রাসেল ঠিক এমনই বলেনঃ পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে আমরা কোনভাবেই লন্ডন কিংবা এডিনবার্গের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারিনা। কিন্তু আমরা শূন্যে দুইটি বিন্দুর অবস্থান কল্পনা করতে পারি, যার একটি হল উত্তরদিকে এবং অন্যটি দক্ষিণ দিকে — যেখানটায় এখন লন্ডন এবং এডিনবার্গ শহর অবস্থিত।“…পূর্বদিক এবং পশ্চিমদিক ইচ্ছাপ্রসূত ও প্রচলনসিদ্ধ, তার মানে দাঁড়ায় ঐতিহাসিক নির্মাণগুলোও এমনই (যেহেতু বাস্তব-ইতিহাসের বাইরে পৃথিবীতে যেকোন বিন্দুই একই সময়ে পূর্ব এবং পশ্চিম হতে পারে)। এটি আরও পরিষ্কারভাবে দেখা যায় এই বিষয়টি থেকে যে, এই পরিভাষাগুলো সাধারণ একজন হাইপোথেটিক্যাল বা প্রকল্পিত বিষাদগ্রস্ত (hypothetical melancholic) মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দানা বাঁধেনি; বরং ইউরোপীয় সংস্কৃতিবান শ্রেণি থেকে এসেছে, বিশ্বব্যাপী মানসিক কর্তৃত্ব যাদেরকে সর্বত্র গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছে। জাপান ইউরোপের জন্যই শুধু দূরপ্রাচ্য নয়; সম্ভবত ক্যালিফোর্নিয়া’য় থাকা আমেরিকানদের জন্যও, এমনকি জাপানীদের (যারা কিনা ইংরেজ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদৌলতে মিশরকে বলবে নিকট প্রাচ্য) নিজেদের জন্যেও।

ঠিক কীভাবে গ্রামশির ধারণাগুলো শ্রাফার সাথে সংযুক্ত এবং তাঁরা নিজেদের মধ্যে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিল তা অধিকতর গবেষণার বিষয়বস্তু।১০ কিন্তু এই দাবিটি যৌক্তিক হয় যে, কোন না কোনভাবে বিশের দশক এবং ত্রিশের দশকের প্রথমভাগে গ্রামশি যে থিম বা আখ্যানবস্তুর সাথে যুক্ত ছিলেন শ্রাফা সেটির সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন। তাই এটি বোঝা খুব কঠিন হয়না, কেন ভিটগেনস্টাইনের ট্রাকট্রেটাসের কার্যক্রম শ্রাফার নিকট (এবং যে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল থেকে তিনি এসেছেন তার ক্ষেত্রেও) গভীরভাবে বিপথগামী মনে হয়েছিল। সেইসাথে এটিও দেখতে পারা কঠিন নয়, “নৃতাত্ত্বিক ভঙ্গিমা”র ফলপ্রসূতা — কেন ভিটগেনস্টাইনের কাছে অভূতপূর্ব ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা — শ্রাফার নিকট পুরোপুরি অস্পষ্ট (বা অনস্বীকার্য নয়) তেমনটা নয়।

৫. পুঁজির মূল্য-নির্ণয় এবং সামাজিক যোগাযোগ

শ্রাফা, গ্রামশি এবং ভিটগেনস্টাইন আলোচিত এই দর্শনগত ধ্যান-ধারণাগুলো (তথাকথিত “নৃতাত্ত্বিক ভঙ্গিমা” এবং অন্যান্য) কী তাৎপর্য বহন করে শ্রাফার অর্থশাস্ত্রগত তাত্ত্বিক রচনায়? তাঁর প্রথম দিককার কাজ, বিশেষ করে ১৯২৫ সালে ইতালীয় ভাষায় এবং ১৯২৬ সালে ইংরেজি রূপে “ইকোনমিক জার্নালে” প্রকাশিত বহুল প্রশংসিত সেই প্রবন্ধটিতে — যেটি প্রাথমিকভাবে শ্রাফার সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠা করে — তিনি তখনকার চলমান অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বের (যা কিনা মূলত আলফ্রেড মার্শাল দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিলো) প্রবণতা নির্দেশ করেন । শ্রাফা ব্যাখ্যা করেন, পূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়া “বাজারের ফলাফল” একটি অন্তর্গত স্ব-বিরোধীতায় আক্রান্ত, যেখানে একক ফার্ম বা ব্যবসালয়গুলোর উৎপাদনে বৃহৎ-পরিমাণের সুবিধা (Economies of large-scale) রয়েছে। শ্রাফার এই বিশ্লেষণ “পরিমাণের সুবিধাদি”র প্রকৃতি এবং পরিপূর্ণ নয় এমন [অপূর্ণ] প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাঠামোর কার্যাবলী নিয়ে বিবেচনাযোগ্য-পরবর্তীকালের-কাজের-পথ তৈরী করে দিয়েছে, যার শুরু হয় জোয়ান রবিনসন (১৯৩৩) এবং এডওয়ার্ড চ্যাম্বারলিনের (১৯৩৩) হাত ধরে। এসব প্রথম দিকের এই অর্থশাস্ত্রগত অবদানগুলো পরবর্তীতে ভিটগেনস্টাইন, শ্রাফা কিংবা গ্রামশি আলোচিত দর্শনশাস্ত্রগত সমস্যাবলীর ধরনে সংকটপূর্ণ হিসেবে হাজির হয়নি।

যাইহোক, শ্রাফার দ্রব্যের নিমিত্তে দ্রব্যের উৎপাদনঃ অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বের একটি সমালোচনার গৌড়চন্দ্রিকা (শ্রাফা, ১৯৬০) বইতে ইন্টারপ্রেট বা ব্যাখ্যা করার মত সমস্যাগুলো ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই সমৃদ্ধ বইটির দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। প্রথমটি হল, পুঁজির সামগ্রিকীকরণ (aggregation) এবং উৎপাদনের উৎপাদক হিসেবে পুঁজির ধারণা। “নিও-ক্ল্যাসিক্যাল অর্থশাস্ত্র” নামে পরিচিত মূলধারার অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বগুলোকে সামগ্রিকীকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে গঠন করা যায়। পুঁজিপণ্য যেমন, যন্ত্রাবলী এবং সরঞ্জাম অবশ্যই অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। এবং “পুঁজি”কে উৎপাদনের একটি সাধারণ উৎপাদক হিসেবে গণনাকারী যেকোন সমষ্টি-সংক্রান্ত হিসাবকে কিছু সমষ্টি-সংক্রান্ত “মডেলিং (modelling, মূর্ত গঠন)” যুক্ত রাখতে হবে। এগুলো আবার সামাজিক যোগাযোগে বোধগম্য ও আলোচনাযোগ্য হতে হবে। সেইসাথে আরেকটি বহুল আলোচিত দাবি রয়েছে যে, বর্ধিত পুঁজির (যাকে পুঁজির প্রান্তিক ফলাফল বলা হয়) উৎপাদনশীলতাকে পুঁজি থেকে প্রাপ্ত লাভালাভের হারের (যেমন সুদের কিংবা লভ্যাংশের হার) মূল্য নির্ধারণকারী হিসেবে দেখা যেতে পারে।

শ্রাফার সমালোচনা এই দাবিগুলোকে প্রতিহত করে। তিনি পুঁজিকে একটি বিকল্প উৎপাদক (surrogate factor) হিসেবে দেখান, যেটিকে সুদের হার থেকে আলাদা করে সাধারণভাবে সংজ্ঞায়ন করা যায়না এবং তথাকথিত পুঁজির প্রান্তিক উৎপাদনশীলতাকে কদাচিৎ-ই সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। বস্তুত উৎপাদনের কলাকৌশলকে, এমনকি কম বা বেশি “পুঁজি ঘনিষ্ঠ” হওয়ার ভিত্তিতে ক্রমবদ্ধ করা যায়না। কেননা তাদের পুঁজি ঘনিষ্ঠতা (যা সুদের হারের উপর নির্ভরশীল) উৎপাদন-কৌশলগুলোর আপেক্ষিক ক্রম পুনঃপুনঃ উল্টে দিতে পারে, যদি সুদের হার কমিয়ে নেয়া হয়।১১

এটি একটি শক্তিশালী প্রায়োগিক ফলাফল। আমরা প্রশ্ন করতে পারিঃ তাতে কী পার্থক্য তৈরি হয়? উৎপাদনের অন্যতম উৎপাদক হিসেবে পুঁজিকে ধরে নেয়া নিও-ক্ল্যাসিক্যাল সমষ্টি-সংক্রান্ত মডেলগুলো অসংশোধনযোগ্য-ভাবে বিনষ্ট হয়। কিন্তু নিও-ক্ল্যাসিক্যাল অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বগুলোর সমষ্টি-সংক্রান্ত আকারে উদ্ভাসিত (expound) হওয়ার প্রয়োজন নেই। উৎপাদনকে আলাদা আলাদা পুঁজিপণ্যের ভিত্তিতে দেখা সম্ভব এবং একে এভাবেই রেখে দেয়া যায়। তাছাড়া সমষ্টি-সংক্রান্ত ভিত্তিতে (যখন শ্রমিকের দর সস্তা এবং পুঁজিব্যয় উচ্চ থাকে, এমন ক্ষেত্রে কম পুঁজি-ঘনিষ্ঠ কলাকৌশল ব্যবহার হয়) তর্ক করার ফলে কেউ নীতিগতভাবে যে প্রায়োগিক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবে, তা সুদের হার প্রকৃতপক্ষে কীভাবে নির্ধারিত হয় তার উপরতো নির্ভরশীল নয়ই এবং পুঁজির মূল্য-নির্ণয়ের বিশেষায়িত কোন মডেলের উপরও শর্তসাপেক্ষ নয়।১২

তা সত্ত্বেও, বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক পর্যায়ে সুদ হচ্ছে পুঁজির উৎপাদনশীলতার পুরস্কার। বরং এটাকে বলতে হয়, শ্রমিকদের কিংবা শ্রমের শোষণের ফলাফল (অথবা কেবল প্রাপ্ত ফলনের [output, আউটপুট] মূল্য এবং নিবেশিত [input, ইনপুট] খরচের মধ্যবর্তী যে নিষ্ক্রিয় অবশিষ্টাংশ থেকে যায় তা; নিবেশিত খরচের মধ্যে বেতন ও পরিশোধও সংযুক্ত)। পুঁজিবাদী তন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে ওঠা সামাজিক বিতর্কগুলোয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সবসময় একে হাজির করা হয়েছে। এভাবে কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা ক্ল্যাসিক্যাল বা চিরায়ত বিতর্কের সাথে মিল রেখে একবার যদি এই সমালোচনার আলোচ্য বিষয়বস্তুকে পরিপূর্ণভাবে অন্তঃগত ও ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে পুঁজিকে উৎপাদনের প্রধান উৎপাদকগুলোর একটি ধরে নেয়া ধারণা নিয়ে শ্রাফার বিধ্বংসী সমালোচনার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝে ওঠা কষ্টকর হবে না। শ্রাফা প্রদত্ত তথ্যগুলোকে উৎপাদনের পুঁজিবাদী তন্ত্রের — মান-নির্ণায়ক বা আদর্শের ধারণা সহকারে উপস্থিত — একটি বিশেষ বিবরণধর্ম বা বর্ণনামূলক হিসাবের (particular descriptive account) প্রত্যুত্তর হিসেবে দেখা যেতে পারে; এবং এখানেই সেই প্রায়োগিক ফলাফলের সম্ভাবনাময় সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা নিহিত।

আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, আমার কাছে প্রতীত বা আস্থাশীল হওয়া পুরোপুরি কঠিন ঠেকে এ বিষয়টিতে, যেখানে অসংযত পুঁজিবাদ নিয়ে কারো সংশয়বাদ শুধু উৎপাদনের অন্যতম উৎপাদক হিসেবে সামগ্রিক পুঁজির প্রয়োজনীয়তা এবং এর উপর আরোপিত উৎপাদনশীলতা জাতীয় বিষয়েই নির্বন্ধ হয়ে থাকতে হবে; অন্যান্য (প্রায়শই অ-বাজারী) প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা সংযত ও সম্পূরকভাবে অবস্থান না করলে পুঁজিতন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট হীন-রাস্তা এবং ধকলপূর্ণ জীবনের উপর দৃষ্টিপাত না করে। তথাপিও শ্রাফার বিশ্লেষণের বিস্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টি এবং পুঁজির উৎপাদনশীলতাকে মুনাফার ব্যাখ্যান ধরে নেয়া নিয়ে উদ্ভূত বিতর্কের জন্য এর তর্কমূলক প্রাসঙ্গিকতা দেখতে অসুবিধা হয়না।

৬. দাম এবং নির্ধারণের দুটি উপায়

দ্বিতীয় উদাহরণটিতে আমরা এসে পড়েছি, এখানে শ্রাফা বিবেচনা করেন অর্থনীতির এমন একটি সাম্যাবস্থা (equilibrium) যেখানে অভিন্ন লাভের (বা সুদের) হার কার্যরত। তিনি দেখান যে, যদি আমরা নিরীক্ষিত যোগান উপাদানসামগ্রী ও উৎপাদসমূহ (observed inputs and outputs) এবং একটি প্রদত্ত সুদের হার সহকারে একটি অর্থনীতিতে বিদ্যমান সকল উৎপাদন কার্যাবলীর সর্বাঙ্গীন বিবরণ সম্বলিত একটি স্ন্যাপশট নিতে পারি, তাহলে এই তথ্য একাই সকল দ্রব্যের দাম নির্ধারণ এবং একইসাথে বেতন ও সুদের (লাভ) মধ্যে প্রাপ্ত আয়ের বন্টন কীভাবে হবে তার নির্দেশনা দেয়।১৩ আমরা যদি সুদ বা লাভের একটি উচ্চ এবং উচ্চতর হার বিবেচনা করি, তাহলে বেতনের হার ধারাবাহিকভাবে নিম্ন এবং নিম্নতর হবে। এভাবে আমরা একটি নিম্নমুখী-ঢালসম্পন্ন বেতন-লাভ (downward-sloping wage-profit relationship) সম্পর্ক নিরূপণ করতে পারি, যা স্থির “শ্রেণি যুদ্ধে”র একটি মোটামুটি সুস্থির চিত্রায়ণ)। সেই প্রদত্ত উৎপাদন পরিস্থিতির জন্য এবং সুদের (অথবা লাভের) হার কিংবা বেতনের হারের সবিস্তার বিবরণীর মাধ্যমে আমরা দ্রব্যাদির মূল্য গণনা করতে পারি।

এই অনুশীলনীতে আসল গুঁটি হিসেবে যে বসে থাকে সে হলো চাহিদা খাতঃ যেহেতু আমরা উৎপাদনের তথ্যাদি থেকে সরাসরি দামে পৌঁছে যাই। এই গাণিতিক অনুশীলনে বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদা শর্তাবলী (যা কিনা এই বিশেষ বিশ্লেষণাত্মক অনুশীলনে বাহুল্য) নিয়ে আসার কোন প্রয়োজনই পড়ে না। এই পরিষ্কার ফলাফলটিকে ব্যাখ্যা করতে অর্থ (meaning, মানে) এবং যোগাযোগের দর্শনগত ভিত্তি আপনাআপনিই হাজির হয়। এটি বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, গাণিতিক পরিসরে (অথবা, “নৃতাত্ত্বিক ভঙ্গিমা”য় বলতে গেলে — গাণিতিক সম্প্রদায়ে এটি কীভাবে বোঝা হবে) “নির্ধারণ” বলতে কী বোঝানো হয়; এবং এই শব্দটির ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যতগুলো বিভিন্ন মানে রয়েছে সেগুলোকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। শ্রাফার এই “সমালোচনা”কে দামের কারণিক নির্ধারণে (causal determination) চাহিদা শর্তাবলীকে বাহুল্যই দেখানো হয়েছে — হিসেবে তুলে ধরার একটি শক্তিশালী প্রবণতা রয়েছে মূলধারার অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বের সমালোচকদের। সেই সূত্রে তত্ত্বটিকে দুর্বল করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, অথচ এই তত্ত্বে চাহিদা এবং উপযোগ সম্পর্কে আনেককিছু বলা হয়েছে। রবিনসন (১৯৬১)-ই এই উপায়ে চটুলতা করা একমাত্র মন্তব্যকারী লোক নয়ঃ

…আমরা যদি উৎপাদনের জন্য প্রায়োগিক সমীকরণের একটি সেট এবং অর্থনীতির সর্বত্রজুড়ে অভিন্ন একটি প্রকৃত বেতন হার পাই, তাহলে সাম্যাবস্থার দাম নির্ধারণে চাহিদা শর্তাবলীর কোন প্রয়োজন নেই। (পৃ. ৫৭)

যাইহোক, এই সম্পূর্ণ গণনা একটি প্রদত্ত ও নিরীক্ষিত [বা পর্যবেক্ষিত] উৎপাদন চিত্রের ভিত্তিতে হয়েছে। সেকারণে দেখা যায়, এই অনুশীলনীতে যদি চাহিদা শর্তাবলীর পরিবর্তন হয় — যা কিনা নিশ্চিতভাবে উৎপাদনের পরিমাণ বদলে দিতে পারে — তাহলে কী ঘটতে পারে সেই প্রশ্নটিকে মোটেই আমলে নেয়া হয়নি।১৪ তাই গাণিতিক নির্ধারণকে কারণিক নির্ধারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করার এই প্রবণতা, একটি গুরুতর ভূল বোঝাপড়ার কারণ হতে পারে।১৫

৭. মূল্য এবং বর্ণনাত্মক গুরুত্ব বা তাৎপর্য

শ্রাফা’র প্রাপ্ত ফলাফলে যদি কারণিক নির্ধারণ সম্পর্কে বেশি কিছু না পাওয়া যায় তারপরেও সেগুলোর প্রতি আগ্রহ থেকে যায় কেন? সামাজিক যোগাযোগের (এই ধারণায় শ্রাফার কাজের অবদান রয়েছে) প্রকৃতি বিবেচনায় আনার মাধ্যমে এর উত্তর মিলবে। প্রথমত, (শুধু কারণিক নির্ধারণ নয়) বিশ্লেষণাত্মক নির্ধারণও এমন একটি বিষয় যা মানুষকে অনেকটাই আগ্রহী করে তোলে। শ্রাফা তুলে ধরেন যে অর্থনীতির উৎপাদনের শর্তসমূহের শুধু একটি স্ন্যাপশট ছবিই আমাদেরকে সম্ভাব্য দামসমূহের ব্যাপারে অনেককিছু জানাতে পারে, এটি শুধুমাত্র একটি উল্লেখযোগ্য বিশ্লেষণাত্মক নির্ণয়ই নয় — বরং উৎপাদিত পরিমাণ এবং ধার্যকৃত দামের মধ্যকার সঙ্গতি নিয়ে যারা ভাবেন তাঁদের কাছে রীতিমতো বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহের বিষয়। গ্রামশি দাবি করেন, প্রত্যেক মানুষই কোন না কোন পর্যায়ের দার্শনিক; এবং সম্ভবত একইভাবে বলা যায় এ ব্যাপারেও যে, বিশ্লেষণাত্মক — এবং এমনকি গাণিতিক — কৌতূহল ব্যাপক বিস্তৃত। এই কৌতূহল আমাদের সামাজিক চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। কেবল নির্ধারিত উৎপাদন খাত (যোগানসমূহ এবং উৎপাদসমূহ [inputs and outputs]) এবং সুদের হার লক্ষ্য করেই দ্রব্যের দাম কেমন হবে তা বুঝে ওঠা সম্ভব — এই ধারণাটি একটি জোরালো বিশ্লেষণাত্মক ফলাফল।

শ্রাফার প্রাপ্ত ফলাফলের প্রতি আগ্রহী হওয়ার পেছনে দ্বিতীয় কারণ হলো, সেগুলোকে ধারণাটির রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এবং মূল্য-ধারণার প্রেক্ষিতে বুঝতে পারা। ক্ল্যাসিক্যাল চিন্তাধারায় “মূল্য”(value)-কে শুধুই দাম (price) নির্ধারণের উপায় হিসেবে দেখা হয়নি (স্মিথ, রিকার্ডো এবং মার্ক্স সকলেই মূল্য থেকে দামে পৌছানোর সমস্যাবলী আলোচনা করেছেন), একইসাথে কিছু সামাজিক গুরুত্বের বর্ণনাত্মক বিবৃতি তৈরি করতেও দেখা যায়। অনেক অর্থনীতিবিদদের কাছে “মূল্য” ধারণাটি পুরোপুরি একগুঁয়ে রূপে আবির্ভূত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রবিনসন প্রত্যক্ষবাদী (positivist) পদ্ধতি ডেকে আনেন, তাকে “বাম-ধারার [কার্ল] পপারের অনুসারী” বলা যেতে পারে। সাধারণভাবে মূল্য-ধারণার যেকোন বাস্তব প্রাসঙ্গিকতা খারিজ করে দিতে এই মেথডোলজি বা পদ্ধতিকে ডেকে আনা হয়; এবং একে বিশেষভাবে নিয়ে আসা হয় মার্ক্সীয় অর্থনীতিতে। তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন (১৯৬৪) বইতে তিনি লিখেন:

এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে সমগ্র যুক্তিতর্কই অধিবিদ্যামূলক হিসেবে আবির্ভূত হয়; অধিবিদ্যামূলক ধারণাগুলো কীভাবে পরিচালিত হয় তার একটি টিপিক্যাল ধারণাও এটি দেয়। যুক্তিগতভাবে এটি নিছক শব্দসমূহের ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া, কিন্তু মার্ক্সের কাছে এটি ছিল একটা রোশনাই বা আলোকবন্যা এবং পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদীদের প্রেরণার উৎস।১৬ (পৃ. ৩৯)

“মূল্য কাজে আসবেনা”, রবিনসন সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। “এর কোন প্রয়োগগত কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু নেই। এটি কেবল একটি শব্দ।“

গ্রামশি, শ্রাফা এবং অবশ্যই ভিটগেনস্টাইন দ্বারা উত্থাপিত দর্শনগত সমস্যাগুলোর এই জিজ্ঞাসায় বিবেচনাযোগ্য সম্পর্ক আছে। ঠিক যেভাবে প্রত্যক্ষবাদী প্রণালীবিদ্যা (positivist methodology) অর্থহীন ঘোষণা করে দেয় কিছু বিবৃতিকে — যখনি সেগুলো যাচাইকরণ কিংবা মিথ্যা প্রতিপাদনের নীতির (falsification) সীমাবদ্ধ শর্তাবলীর উপর নির্ভর করে “অর্থ বা মানে”র সংকীর্ণ অর্থের সাথে মানানসই হয়না, তেমনিভাবে ট্রাকট্রেটাসও বিবৃতিসমূহে বিষয়াদির বা ঘটনাবলীর (state of affairs) একই যৌক্তিক গঠন উপস্থাপন করেনা এমন উপাদান খুব কমই দেখতে পায়। এর থেকে যা পাওয়া যায় তাকে সাইমন ব্ল্যাকবার্ন (১৯৯৪) যেভাবে বলেন তা হলো, “বাক্যের বাস্তবিক কিংবা জ্ঞানজ (factual or cognitive) অর্থবোধকতা যেগুলোর কার্যাদি উপস্থাপনের ধারণার মধ্যে যুতসই হয়না [অর্থাৎ তথ্য দেয়না] — যেমনঃ নীতিশাস্ত্র, মানে বা অর্থ কিংবা সত্তা সংক্রান্ত অর্থগুলো” (পৃ. ৪০১) — তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা। অন্যদিকে শ্রাফা দ্বারা আংশিকভাবে প্রভাবিত উত্তর-পর্বের ভিটগেনস্টাইনের অনুসৃত দর্শনগত পন্থা মানে বা অর্থবোধকতাকে আরও বিস্তৃতরূপে দেখে।১৭

মূল্যের ব্যাখ্যা এবং এটির বর্ণনাত্মক প্রাসঙ্গিকতা ভালোভাবে স্থান করে নিয়েছে মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ মরিস ডোব (১৯৩৭, ১৯৭৩)-এর আলোচনায়, যিনি আবার শ্রাফার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন এবং ডেভিড রিকার্ডোর সংগৃহীত কাজগুলোর সম্পাদনায় দীর্ঘদিনের সহযোগী ছিলেন। মানুষের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলোর অর্থপূর্ণ বর্ণনায় সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থের উপর ডোব জোর দিয়েছেন। এমনি “শোষণ”-এর মত ধারণাগুলোও যেখানে (রবিনসন সহ) কারো কারো কাছে “অধিবিদ্যক” হিসেবে আবির্ভূত হয়, সেগুলোকেও অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলোয় সামাজিক অপ্রতিসাম্যতা সম্পর্কে যোগাযোগের ভাষায় একটি সাধারণ জনউদ্বেগের প্রতিফলন করার চেষ্টা রূপে দেখা যেতে পারে। যেমনভাবে ডোব (১৯৭৩) লিখেছেনঃ

“শোষণ” অধিবিদ্যাগত কিছুও নয়, আবার কেবলমাত্র “নীতিগত” ফয়সালাও (still less “just a noise”) নয় যেরকমভাবে মাঝেমধ্যেই একে দেখানো হয়ে থাকে! এটি হলো একটি আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের একটি বাস্তবিক বর্ণনা — যেমনটা মার্ক ব্লখ (Marc Bloch)-এর করা সামন্তবাদের সুনিপুণ চরিত্রায়ন (যেখানে সামন্তপ্রভূরা “বেঁচে থাকে অন্য লোকেদের শ্রমের উপর নির্ভর করে)।“ (পৃ. ৪৫)

উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে শ্রাফার বিশ্লেষণ এবং খরচ ও দামের (অর্থনীতির স্ন্যাপশট ছবিতে থাকা) মধ্যকার সঙ্গতি যেখানে মার্ক্সীয় ধাঁচের শ্রম-ভিত্তিক বর্ণনার চেয়ে আলাদা, একই সাথে সামাজিক সম্পর্কগুলোকে উপযোগ কিংবা মানসিক শর্তাবলীর ভিত্তিতে নয় বরং উৎপাদনের খাতের উপর দৃষ্টিনির্বন্ধ রেখে প্রকাশ করার চেষ্টাও বটে। আমরা তর্ক করতে পারি এই দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃতি কতদূর তা নিয়ে; কিন্তু এটি দেখা গুরুত্বপূর্ণ যে, শ্রাফার বিশ্লেষণের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে (উৎপাদন খাতের আন্তঃসম্পর্কের উপর ভর করে) দাম এবং আয়ের বন্টন সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বর্ণনা।

এ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত আরেকটি সমস্যা রয়েছে “ব্যবহার-মূল্য (use-value)” এবং “বিনিময়-মূল্যের (exchange-value)” মধ্যকার ধ্রুপদী দ্বি-বিভাজনকে (dichotomy) অ্যাড্রেস করার সাথে জড়িত। এই সমস্যা গঠিত হয়েছে আধুনিক অর্থশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের বিশেষ করে অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো’র মাধ্যমে। শ্রাফা এবং রিকার্ডোর সংগৃহীত কাজগুলোর সম্পাদনায় তাঁর সহযোগী [মরিস] ডোবের বিপুল আগ্রহ ছিল এই প্রশ্নকে ঘিরে১৮; এবং আমি এখন আলোচনাকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছি।

৮. ব্যবহার, বিনিময় এবং কাউন্টারফ্যাক্টুয়াল্‌স (Counterfactuals)

১৮১৭ সালে প্রকাশিত ডেভিড রিকার্ডোর রাজনৈতিক অর্থনীতি ও কর আরোপণের নীতিমালা নামের বুনিয়াদি বইয়ের শুরুটা হয় এই রচনাংশের মাধ্যমেঃ

অ্যাডাম স্মিথ লক্ষ্য করেন যে, মূল্যের দুইটি ভিন্ন অর্থ রয়েছে। কখনো তা একটি বিশেষ বস্তুর উপযোগ প্রকাশ করে, আবার কখনো সেই বস্তুটির মালিকানার ফলে অন্যান্য পণ্য কিনতে পারার সামর্থ্যকেও বোঝায়। প্রথমটিকে ব্যবহার মূল্য (value in use) এবং দ্বিতীয়টিকে বিনিময় মূল্য (value in exchange) বলা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, “যে সকল জিনিসের ব্যবহার মূল্য বেশি থাকে, সেগুলোর বিনিময় মূল্য খুব অল্প বা একেবারেই থাকে না; অপরদিকে যেসব জিনিসের বিনিময় মূল্য বেশি রয়েছে, সেগুলোর ব্যবহারিক মূল্য স্বল্প কিংবা নেই।“ পানি এবং বাতাস প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার্য — মূলত বেঁচে থাকার জন্য এগুলো অত্যাবশ্যক, তারপরেও সচরাচর পরিপ্রেক্ষিতে এগুলোর বিনিময়ে কিছুই পাওয়া যায়না। অপরদিকে ব্যবহারের দিক থেকে পানি কিংবা বাতাসের চেয়ে স্বর্ণ কম কাজে আসে, কিন্তু এর বিনিময়ে বহুল পরিমাণে অন্যান্য পণ্য পাওয়া যায়।

এখানে একটি ধাঁধা রয়েছে যা নিজে থেকেই কিছুটা আগ্রহের উদ্রেক করে এবং দাম ও মূল্য সম্পর্কে সাধারণভাবে আমরা কীভাবে চিন্তা করতে পারি সে ব্যাপারেও কিছুটা ধারণা দেয়। মানুষের জীবনের জন্য পানির চেয়ে কম গুরুত্ব বহন করেও স্বর্ণ কীভাবে পানির চেয়ে বেশি দাম দখল করে তা সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করার দুটি উপায় রয়েছে। এই বর্ণনায় উপযোগের দিকটায় নির্ভর করে প্রথম উত্তরটা হলো, সাধারণভাবে পানি বিপুল পরিমানে সহজলভ্য হলেও স্বর্ণের ক্ষেত্রে তা না হওয়ায় স্বর্ণের প্রান্তিক উপযোগের তুলনায় পানির তথাকথিত “প্রান্তিক উপযোগ” (অতিরিক্ত এক একক থেকে ভোক্তা যে পরিমাণ বর্ধিত সুবিধা ভোগ করে) কম। আরেকটি উত্তর হলো, অর্থনীতির যে পরিস্থিতিতে আমরা নিরীক্ষণ চালাচ্ছি এখানে উৎপাদনের খরচ অর্থাৎ স্বর্ণ পেতে খননের যে খরচ তা পানির চেয়ে অনেক বেশি।

এর মধ্যে কোন ব্যাখ্যাই বিদ্যমান দাম ও পরিমাণ কেন এবং কীভাবে প্রকৃতপক্ষে উদ্ভূত হয়েছে তার ক্রমিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে না। ব্যাখ্যাগুলো বরং স্মিথ-রিকার্ডোর প্রশ্নের উত্তর দেয়ঃ কীভাবে লোকজন বুঝবে স্বর্ণ কেন “পানি কিংবা বাতাসের তুলনায় কম ব্যবহার্য” হয়েও পানি বা বাতাসের চেয়ে “অনেক বেশি পরিমাণে অন্যান্য পণ্যের“ বিনিময় লাভ করে? উৎপাদনের খরচ ও প্রান্তিক প্রয়োজনীয়তার (যেগুলোকে সামাজিক যোগাযোগের পন্থা এবং সর্বসাধারণের বোঝাপরা হিসেবে ধরা যেতে পারে) মত ধারণাগুলোর উপর ভর করে খরচ-ভিত্তিক ব্যাখা এবং উপযোগ-ভিত্তিক ব্যাখ্যা আসলে আমরা যা পর্যবেক্ষণ করি সেগুলো প্রকাশ করার বিকল্প উপায়াবলী।

শ্রাফা নিজে যেখানে ব্যাখ্যাগত এই প্রশ্নের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত (“কাউন্টারফ্যাক্টুয়াল [‘যদি ফ্যাক্টের থেকে ভিন্ন কিছু ঘটত তাহলে কি/যে পরিণতি ঘটতে পারতো’]” ধারণাগুলোর ব্যবহারের প্রভেদকরণের উপর একটি মন্তব্য করা ব্যতীত, সেটির উপর আরও সরাসরিভাবে) কোন লেখা প্রকাশ করেননি, সেখানে এই সমস্যাকে ঘিরে আমরা কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি পেতে পারি শ্রাফার বন্ধু ও সহযোগী মরিস ডোবের লেখায়। বস্তুত তাঁর রাজনৈতিক অর্থনীতি ও পুঁজিবাদ (১৯৩৭) বইতে অন্তর্ভূক্ত একটি ক্ল্যাসিক গবেষণাপত্র “মূল্যতত্ত্বের প্রয়োজনীয় ধারণাগুলো”তে ডোব দাবি করেন, শুধু দাম-তত্ত্বে (price theory) নিছক যান্ত্রিক ব্যবহার রয়েছে এমন একটি তৈরিকৃত যন্ত্র (mechanical device) হিসেবে একটি মূল্যতত্ত্বকে দেখা যাবে না। মূল্যতত্ত্বগুলো, ব্যবহার মূল্য এবং বিনিময় মূল্যের দ্বৈত গঠনের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে (এমনকি যেভাবে “স্মিথ-রিকার্ডো প্রশ্ন”টিকে সামনে আনে; তেমনি) পণ্যের বর্ধিত ব্যবহারযোগ্যতা, পণ্যের উৎপাদিত সন্তুষ্টি, পণ্যগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত শ্রম অথবা সেগুলোর উৎপাদনের পেছনে সংঘটিত খরচ ও এইসব ব্যাপারে মনোযোগ রেখে অর্থনৈতিক জগতের প্রকৃতির উপর নিজেরাই গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি তৈরি করার চেষ্টা করে।

ক্ল্যাসিক্যাল রাজনৈতিক অর্থনীতি, এবং ক্ল্যাসিক্যাল মার্ক্সীয় অর্থশাস্ত্রে’র একটি মূল্যতত্ত্বের কাছ থেকে দাম-তত্ত্বে নিখাদ যান্ত্রিক “মধ্যবর্তী পণ্য (intermediate product)”-এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু আশা করবার প্রবৃত্তি নিশ্চিতভাবে সুবিদিত। বস্তুত, বৃহৎ রাজনৈতিক কারণে “মূল্যের শ্রমতত্ত্বে (labor theory of value)”র প্রাসঙ্গিকতার কল্পিত নায্যতা প্রতিপাদনে এই প্রবৃত্তি বিশেষ ওকালতির কাজ করে প্রায়শই। যাইহোক, এই নির্ণয় নায্যতার চেয়ে ক্ল্যাসিক্যাল পরিপ্রেক্ষিত কম অনুসরণ করে, যেহেতু ক্ল্যাসিক্যাল পন্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও যোগাযোগের গুরুত্ব। মূলত এখানে এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা জরুরী ক্ল্যাসিক্যাল রাজনৈতিক অর্থনীতি ও মার্ক্সীয় অর্থশাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত শ্রম এবং উৎপাদনের উপরই শুধু গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। “ব্যবহার মূল্য” (এবং সন্তুষ্টি আকারে এটার উত্তরসূরী ধারণা পণ্য দ্বারা আনীত “উপযোগ”) ধারণার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে শ্রমতত্ত্ব ও উপযোগতত্ত্ব নামের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী মূল্যতত্ত্বের তুলনায় আগ্রহী হওয়ার পেছনে যথাযথ কারণ হলো দুটিই সামাজিকভাবে বিজরিত বিবৃতি (socially engaging statements) দেয়। মূল্যতত্ত্ব হিসেবে উপযোগতত্ত্বে সামাজিক স্বার্থের প্রকৃতিকে অস্বীকার করার জো নেই এবং এখানে তা করবার কোন চেষ্টা নেই বলা বাহুল্য।

প্রকৃতপক্ষে, ১৯২৯ সালে “প্রকাশ্য পছন্দক্রম (revealed preference)” পন্থায় (এই অ্যাপ্রোচ বা পন্থা ১৯৩৮ সনে স্যামুয়েলসন কর্তৃক পরিচালিত হয়েছিল) পরবর্তী বিকাশ কী হতে পারে তার একটি দূরদর্শী পূর্বসমালোচনায় ডোব (১৯২৯) আফসোস করেন, সঠিক পছন্দমূলক আচরণের পক্ষে উপযোগের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর প্রতি আধুনিক অর্থশাস্ত্রের দূরত্ব বজায়ের প্রবণতা দেখে (পৃ. ৩২):

আদতে আধুনিক তত্ত্বের সম্পূর্ণ প্রবণতা হলো… মনস্তাত্ত্বিক ধারণাগুলোকে ত্যাগ করাঃ উপযোগ এবং অনুপযোগ-কে বাজারে লক্ষিত বিক্রয় প্রস্তাবগুলোর সাথে সমাপতনিক (coincident) করা; একটি “দাম-তত্ত্ব” লাভের আশায় “মূল্যতত্ত্ব”কে ত্যাগ করা। কিন্তু এতে বশ্যতা স্বীকার হলো, সমাধান হলো না সমস্যাটির।১৯

বস্তুত, যে “সমস্যা”টি ডোব নির্দেশ করেছেন এবং শ্রমতত্ত্বের মত মূল্যের উপযোগতত্ত্বও যার সেবার নিয়োজিত তা হলো, “অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃতি সম্বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণবাচক বিবৃতি” তৈরি করা (ডোব, ১৯৩৭; পৃ. ২১-২২)। এই দুই ধরনের সামাজিক ব্যাখার মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করতে ডোব বলেন, “উৎপাদন সম্পর্কসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট না হওয়ায় গুণবাচক বিবৃতিটি (উপযোগ তত্ত্ব) অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের, কিন্তু সেটি দ্রব্যের সাথে ভোক্তার মনস্তত্ত্বের সংযোগ স্থাপন করে” (পৃ. ২১)। অন্যদিকে, শ্রাফার দেখানো অর্থনীতির চিত্র বিশেষভাবে “উৎপাদন সম্পর্কসমূহের” উপর মনোযোগ আবদ্ধ করে, এবং শ্রাফার অবদানগুলো প্রকাশ করতে ডোব (১৯৭৩) তাই এই বৈপরীত্য অনুসরণ করেন।

যথাযোগ্য প্রমাণ সহকারেই বলা যায়, এই বৈপরীত্য বিশেষ করে শ্রাফার নিজের কাছেই আগ্রহের ছিল। কিন্তু এই তুলনায়, শ্রাফা আরেকটি বড় পার্থক্য দেখতে পান যা কিনা তাঁর জন্য পদ্ধতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল (যদিও এটি ডোবকে কিছুটা আগ্রহী করে তুলেছে — এমন প্রমাণ আমার কাছ তেমন নেই)। এই পার্থক্যটি ঘটে, বাস্তব তথ্যমূলক বর্ণনায় কাউন্টারফ্যাক্টুয়াল বিস্তৃতি (magnitude) ডেকে আনার ব্যাপারে শ্রাফার দর্শনগত সংশয়ের কারণে। শ্রাফা উল্লেখ করেন যে, খরচ-ভিত্তিক ব্যাখায় (শ্রাফা, ১৯৬০-এর সাথে মিল রেখে) বেছে নিতে গেলে আমরা সম্পূর্ণভাবে “নিরীক্ষিত বা পর্যবেক্ষিত” বাস্তব তথ্যসমূহ, যেমন নিবেশিত উপাদানসমূহ ও উৎপাদসমূহ, একটি নির্দিষ্ট সুদের হার — এসবের উপরই নির্ভর করতে পারি কোন প্রকার “পরস্পরবিরোধিতা”কে (মানে, বিষয়গুলো ভিন্ন হলে ফলাফল কী হতে পারতো তা আগে থেকেই অনুমান করে নেয়া ব্যতিত’ই) ডেকে আনা ছাড়াই।২০ উপযোগ-ভিত্তিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এরকম হতে পারে না, যেহেতু “প্রান্তিক উপযোগ” ধারণাটি অনিবার্যভাবেই পরস্পরবিরোধী যুক্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত; কারণ এই ধারণাটি প্রকাশ করে যদি কেউ কোন দ্রব্যের অতিরিক্ত আর একটি একক পায় তাহলে সে ব্যক্তি কতখানি অতিরিক্ত উপযোগ পাবে তার পরিমাণ।

জ্ঞানতত্ত্বে (Epistemology) এই পরস্পরবিরোধিতার দর্শনগত অবস্থান রীতিমতো বিতর্কের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। জগতকে বোঝার চেষ্টায় কাউন্টারফ্যাক্টুয়ালকে বাদ দিয়ে দেয়ার চেষ্টার মধ্যে আমি তেমন ভালো কিছু দেখতে পাইনা।২১ শ্রাফার সঙ্গে বিস্তৃত আলাপচারিতা থেকে আমি জানি যে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পরস্পরবিরোধিতার ব্যবহারে অসুবিধা রয়েছে যা বিশুদ্ধভাবে নিরীক্ষণমূলক প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে থাকে না। এমন নয় যে, তিনি কখনোই কাউন্টারফ্যাক্টুয়াল ধারণাসমূহ ব্যবহার করেননি (এমন ব্রত মানলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারতো); কিন্তু তিনি ভেবেছেন এখানে বড়সড় পদ্ধতিগত বিভাজন রয়েছে। পরস্পরবিরোধিতার অ-নির্ভরযোগ্যতার উপর শ্রাফার বিচার-বিশ্লেষণের সাথে কেউ একমত হোক আর না হোক, এটি প্রকৃতপক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ যে উপযোগ-ভিত্তিক ও খরচ-ভিত্তিক গল্পে (শ্রাফার ভাষায়) এমন একটি পদ্ধতিগত বৈপরীত্য রয়েছে। প্রথমোক্তটিতে উপযোগ আকারে মানসিক শর্তাবলীর উপর মনোযোগ স্থির করা হয়েছে এবং শেষোক্তটিতে উৎপাদনের বস্তুগত শর্তাবলীর উপর অভিনিবেশ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সহজভাবে চোখে পড়ে এমন একটি বৈপরীত্য — কেবলমাত্র এখানেই পার্থক্য নিহিত নয় বরং প্রথমোক্তটিতে কাউন্টারফ্যাক্টুয়ালকে ডেকে আনতে হয় কিন্তু শেষোক্তটিতে শ্রাফার গঠনপদ্ধতি অনুযায়ী এর প্রয়োজন পড়েনা — এই স্বল্প-স্বীকৃত স্বাতন্ত্র্যেও নিহিত।

৯. সমাপনী বক্তব্য

ট্রাকটেটাস থেকে সরে গিয়ে পরবর্তীকালের তাত্ত্বিক প্রকাশ ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশন্সের দিকে প্রবর্তিত হতে ভিটগেনস্টাইনকে সাহায্য করার মাধ্যমে সমসাময়িক দর্শনশাস্ত্রে অসামান্য দিকগত বা অভিমুখের পরিবর্তনের অবদানে পিয়ের শ্রাফার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা প্রভূতভাবে ভিটগেনস্টাইনের নিজের দ্বারা (এবং তাঁর জীবনীকারদের দ্বারাও) স্বীকৃত। যাহোক, যে বিষয়টা গোলমেলে ঠেকে তা হলো, এই প্রভাবের গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতি এবং এর মূলগত ধারণাগুলোর মাহাত্ম্য সম্পর্কে শ্রাফা বরং অনুত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু গোলমালের প্রখরতা অনেকটাই কমে গিয়েছে এই স্বীকৃতির মাধ্যমে যে, এই সমস্যাগুলো ইতালিতে শ্রাফা যেখানে ছিলেন সেখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের (যেখানে গ্রামশিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন) মানসম্পন্ন আলোচনাগুলোর অংশ ছিল।

যার ফলে ট্রাকটেটাসে ভাষা এবং অর্থ বা মানে নিয়ে ভিটগেনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা কিংবা পরবর্তীকালে আবার ভাষা ও অর্থ’কে বুঝতে “নৃতাত্ত্বিক ভঙ্গিমা” বিবেচনায় নিয়ে আসাটা শ্রাফার কাছে কোন আশ্চর্য্য ব্যাপার হিসেবে হাজির হয়নি। পূর্ববর্তী ভিটগেনস্টাইন থেকে উত্তর-পর্বের ভিটগেনস্টাইনে পরিবর্তিত হওয়ার পেছনে একটি সুস্পষ্ট “গ্রামশি সংযোগ” রয়েছে; সেই একই বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে যে ধারণাগুলো উদ্ভূত হয়েছে তাতে শ্রাফা এবং গ্রামশির নিজ নিজ অবদানগুলোকে আলাদা করতে (যদি তা আদৌ সম্ভব হয়) যদিও এখানে আরও বেশি পরিমাণে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

শ্রাফার অর্থশাস্ত্রগত অবদানগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় সেগুলোকে সাধারণভাবে শ্রাফার দর্শনগত বোঝাপড়া থেকে আলাদা করে দেখা যায়না। ফার্ম বা ব্যবসালয় তত্ত্বের (theory of the firm) উপর তাঁর প্রথমদিকের লেখাগুলোর (এবং “একচেটিয়া” অথবা “অপূর্ণ” পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতা বিবেচনা করার প্রয়োজন দেখিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ) পরে তাঁর পরবর্তী সময়ের কাজ মূলধারার অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্নাবলীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন উত্তর খোঁজার পথে হাটেনি। বরং মূলধারার অর্থশাস্ত্রে যুক্ত জিজ্ঞাসাগুলোর প্রকৃতিকে পরিবর্তন এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্ধন করেছেন। এই প্রবন্ধে আমি দাবি করেছি যে, সাধারণ বর্ণনাত্মক স্বার্থে শ্রাফার বের হয়ে যাওয়াকে অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বে যোগাযোগসংক্রান্ত ভূমিকার ভিত্তিতে (সেগুলোকে দাম নির্ধারণ ও বন্টনের বিকল্প কারণিক তত্ত্ব হিসেবে নির্মাণ করার চেষ্টারূপে না দেখে) ব্যাখ্যা করা সম্ভব।২২

রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে সর্বসাধারনের আলোচনার বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করতে শ্রাফা বিশ্লেষণাত্মক যুক্তি প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে, লাভকে পুঁজির উৎপাদনশীলতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে — এই মতবাদের ভঙ্গুরতা তুলে ধরেন তিনি। আরও গাঠনিকভাবে বললে, সুস্পষ্টভাবে বর্ণনায় মূল্যতত্ত্বের গুরুত্বের উপর শ্রাফার কাজ আলোকপাত করে। দামের উপযোগ-ভিত্তিক এবং খরচ-ভিত্তিক ব্যাখ্যার বৈপরীত্য প্রাসঙ্গিক বর্ণনার জগত ও সামাজিক আলোচনার অধিভুক্ত, এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বর্ণনাগুলো সাধারণ আগ্রহের বিষয়; অতীতেও এগুলোকে তলব করা হয়েছে এবং বর্তমানেও এগুলো প্রাসঙ্গিক। বিকল্প বর্ণনাগুলোতে অন্বেষণ করা দামের-কারণিক-নির্ধারণের-বিষয়বস্তু — যেখানে চাহিদা ও যোগান খাত যুগপৎভাবে জড়িত থাকার প্রবণতা রয়েছে — থেকে ভিন্নতর।

এখানে জন হিক্‌সের (১৯৪০, ১৯৮১) ক্ল্যাসিক শুদ্ধিকরণের সাথে একটি সুস্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। ক্ল্যাসিক শুদ্ধিকরণের বেলায়, দাম নির্ধারণ তত্ত্বে উপযোগ এবং খরচ উভয়েরই প্রয়োজন হয়। তবে “সামাজিক আয়ের মূল্যায়ন”-এর কথা যখন আসে, তখন দাম ব্যাখ্যা করতে উপযোগ এবং খরচ — সামাজিক অথবা জাতীয় আয়ের বোঝাপড়ার উপর — দুটি পৃথক উপায় হাজির করে। সামাজিক আয়ের পরিমাপ “প্রকৃত অর্থে উপযোগের ভিত্তিতে কিংবা খরচ সাপেক্ষে মূল্যায়ন বোঝাতে পারে, এবং দুটি অর্থই নীতিগতভাবে ভিন্ন” (হিক্‌স, ১৯৮১; পৃ. ১৪২)।২৩

উপযোগ এবং খরচের মধ্যকার বর্ণনাত্মক স্বাতন্ত্র্যের অন্বেষণ করতে গিয়ে, শ্রাফা সেই প্রদর্শনের (demonstration বা দেখানো) সঙ্গে গুরুত্ব সংযুক্ত করে নেন যেখানে তাঁর হিসাব অনুযায়ী খরচ-ভিত্তিক গল্প (শ্রাফা, ১৯৬০-তে বর্ণিত) পরস্পরবিরোধী পূর্বানুমানসমূহ ডেকে আনার চেয়ে বরং নিরীক্ষিত তথ্যের উপর কেবল নির্ভর করে। উপযোগ-ভিত্তিক চিত্রের চেয়ে এটি ভিন্ন, কারণ প্রান্তিক উপযোগের ধারণাটি গঠনগতভাবেই পরস্পরবিরোধী। পরস্পরবিরোধীতা সহকারে এবং এটিকে ছাড়া যে বর্ণনায়ন (বর্ণনা বা বিবরণ) রয়েছে তাদের মধ্যকার প্রভেদ কীভাবে পদ্ধতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা প্রকৃতপক্ষে একটি উন্মুক্ত প্রশ্নই থেকে যায় (সংশয়বাদী হয়ে থাকাটা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি)। কিন্তু এটি এমন একটি বিষয়বস্তু, শ্রাফা নিজেই এটার সঙ্গে অসামান্য গুরুত্ব যোগ করেছেন। শ্রাফার তেজস্বী কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সঠিক সনির্বন্ধ উক্তি — তাঁর বিশ্লেষণে পরিমাণের উপর নিয়ত লাভালাভ (returns) নিয়ে কোন অনুমান স্থির করতে হয়না — সহকারে শ্রাফার বিশ্লেষণের অন্যান্য পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহের সঙ্গেও এটি সম্পর্কিত।২৪

শ্রাফার অবদানকে (রহস্যজনকভাবে, চাহিদা শর্তাবলীকে কোন ভূমিকা প্রদান না করেই) দাম নির্ধারণের একটি কারণিক তত্ত্ব হিসেবে দেখার প্রবণতাকে প্রতিহত করতে হবে। সবকিছু এখানে “নির্ধারণ”-এর অর্থ এবং শ্রাফা এই পদটিকে যেভাবে দেখেছেন তার ব্যবহারের উপর মুখাপেক্ষী। একগুচ্ছ তথ্যাদি থেকে আরেকগুচ্ছ তথ্যাদির গাণিতিক নির্ধারণের মাধ্যমে শ্রাফার কাছে “নির্ধারণ”-এর জ্ঞানটি পৌঁছায়। এই নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুটি বিশদভাবে তুলে ধরতে (বরং একটি চূড়ান্ত উদাহরণের সাহায্যে) বলা যায়, একটা সূর্যঘড়ি (sundial) কোন একটা নির্দেশকের ছায়ার দিকে তাকিয়ে এখন কয়টা বাজে তা আমাদেরকে “নির্ধারণ” করে দেয়, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে ঐ নির্দেশকের ছায়াটি “কারণিকভাবে নির্ধারণ” করে এখন সময় কত হলো। একটা ঘড়ির মূল্য, দিনের সময় “নিরূপণ” করে দেয়ার মধ্যে নয় বরং “বলে” দেয়ার মধ্যে নিহিত।

এটি খুবই আশ্চর্য্যের হবে যদি, পিয়ের শ্রাফা তাঁর অর্থশাস্ত্রগত বিশ্লেষণে নিজের দার্শনিক অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত না হন এবং সাধারণভাবে প্রত্যক্ষবাদী কিংবা উপস্থাপনমূলক (positivist or representational) যুক্তি প্রক্রিয়া নির্ভর মূলধারার অর্থশাস্ত্রের সীমিত ক্ষেত্রের মধ্যেই রয়ে যান। সাধারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট অর্থশাস্ত্রগত সমস্যাগুলোকে (এর মধ্যে কিছু কিছু দুইশো বছরের বেশি সময় ধরে আলোচিত হয়ে এসেছে) মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে শ্রাফা উল্লেখযোগ্যভাবে সেই সংকীর্ণ বেষ্টনীগুলো মাড়িয়ে গেছেন। আমি মনে করি — এটি জেনে রাখা স্বাচ্ছন্দ্যেরও বটে — আমাদের অনেক পিয়ের শ্রাফা নন, বরং একজনই ছিলেন।

— — — — — —

পাদটীকা

[১] সেনঃ ট্রিনিটি কলেজ।

[২] “Piero Sraffa: Convegno Internazionale”, Academia Nazioale dei Lincei, ১১-১২ই ফেব্রুয়ারী, ২০০৩। এই প্রবন্ধটি সংকলিত হয় সেখানে [Academia Nazioale dei Lincei-তে] পঠিত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ (“Piero Sraffa: A Student’s Perspective, যেটি অ্যাকাডেমিয়া দ্বারা প্রকাশিত হবে) থেকে। বহু বছর ধরে চলতে থাকা সহায়ক আলাপ-আলোচনার জন্য কেনেথ অ্যারো, কৌশিক বসু, ক্রিস্টোফার ব্লিস, নিক ডেনিয়ার, মরিস ডোব, পিয়েরাঞ্জোলো গ্যারেংইয়ানি, ফ্রাঙ্ক হান, জিওফ্রে হারকোরট, জন হিক্‌স, হাইন কুর্জ, ব্রায়ান ম্যাগানিজ, জেমস মিরলিস, রবার্ট নজিক, লুইজি পাসিনেত্তি, সুজি পেইন, হিলারি পাটনাম, জোয়ান রবিনসন, এমা রথচাইল্ড, রবার্ট সলো, লুইজি স্পাভেনতা এবং স্টেফানো জামানি, এবং অতি অবশ্যই খোদ পিয়ের শ্রাফার কাছে আমি ব্যাপকভাবে ঋণী। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শের জন্য এই সাময়িকীর সম্পাদক এবং বিচারকদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।

[৩] এটি সম্পর্কে অন্যান্য লেখাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে, দেখুনঃ পিয়েরাঞ্জোলো গ্যারেংইয়ানি (১৯৬০, ১৯৯৮); আলেসান্দ্রো রঙ্কালিয়া (১৯৭৮, ১৯৯৯); লুইজি পাসিনেত্তি (১৯৭৯, ১৯৮৮); নিকোলাস ক্যালডোর (১৯৮৪, ১৯৮৫); জন ইওয়াল এবং কার্লো পানিকো (১৯৮৭); পল স্যামুয়েলসন (১৯৮৭, ২০০০এ, বি); পাওলো সিলেসি লাবিই (১৯৯০); বেহট্রাম শেফল্ড (১৯৯৬)।

[৪] এই রূপান্তর সম্পর্কিত বিষয়াবলীর জন্য আরও দেখুন, ভিটগেনস্টাইন (১৯৫৩, ১৯৫৮)।

[৫] দেখুন, উদাহরণস্বরূপঃ বহুল প্রচলিত The New Palgrave: A Dictionary of Economics (ইওয়াল, মিলগেট এবং নিউম্যান ১৯৮৭)। অন্যান্য অনেক বইয়ের মধ্যে, শ্রাফার জীবন এবং অবদান নিয়ে ইংরেজিতে লেখা বইগুলো হলোঃ ইন স্টিডম্যান (১৯৭৭, ১৯৮৮); রঙ্কালিয়া (১৯৭৮); জঁ-পিয়ের পোটি (১৯৮৭); শেফল্ড (১৯৮৯); কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং বেহট্রাম শেফল্ড (১৯৯০); তেরেনজিও কজছি এবং রবার্তো মার্খিয়োনাত্তি (২০০০); এবং হাইন কুর্জ (২০০০)।

[৬] দেখুন, স্যামুয়েলসন (১৯৮৭, ২০০০এ, ২০০০বি)। আরও দেখুন, ফ্রাঙ্ক হান (১৯৮২)।

[৭] এই সম্পর্কে অন্যান্য লেখাগুলোর পাশাপাশি দেখুন, ব্রায়ান ম্যাগানিজ (১৯৮২); রে মঙ্ক (১৯৯১); পাওলো আলবানি (১৯৯৮); এবং জন ডেভিস (২০০২)।

[৮] ভিটগেনস্টাইন শুধু শ্রাফাকে প্রশংসাই করতেন না, তাঁর কিছু দর্শনগত রচনাবলীর সুরক্ষার জন্যও তিনি শ্রাফার উপর ভরসা করতেন। শ্রাফা ১৯৫৮ সালের সাতাশে আগস্টে ফন হাইট’কে লিখেন (ট্রিনিটি কলেজের রেন গ্রন্থাগারে [Wren Library] রক্ষিত শ্রাফার হাতে লেখা পত্রের অনুলিপি):

আমার কাছে থাকা [ভিটগেনস্টাইনের] ব্লু বুক (Blue Book)-এর পাণ্ডুলিপির সাথে সম্প্রতি প্রকাশিত সংস্করণের (ভিটগেনস্টাইন, ১৯৫৮) তুলনা করতে আমি দেখতে পাই ভিটগেনস্টাইনের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতে ছোটখাট কিছু সংশোধন রয়েছে যেগুলো ছাপা সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বইটি আগে যার কাছে থাকত, [১৯৪১ সালে] তাঁর (স্কিনার) মৃত্যুর অল্প সময় পরেই বইটি আমাকে দেয়ার সময় আমার ধারণা ভিটগেনস্টাইন সেই সংশোধনগুলো করেন।

[৯] গ্রামশি এবং শ্রাফার মধ্যকার বন্ধুত্ব সম্পর্কে দেখুন, নেরিও নালদি (২০০০)। তাঁদের মধ্যকার বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান বহু রকমের বিষয়বস্তুর সাথে সংযুক্ত ছিল; এবং জন ডেভিস (১৯৯৩, ২০০২) গবেষণা করেছেন শ্রাফার চিন্তাভাবনার উপর “হেজেমনি বা আধিপত্য [কিংবা সলিমুল্লাহ খানের তর্জমায় বলা যায়, নেতৃত্ব]”, “সিজারিজম (caesarism)” এবং “প্রাক্সিস বা কর্মকাণ্ড”-এর গ্রামশীয় ধারণার প্রভাব এবং কীভাবে এই ধারণাগুলো শ্রাফার মাধ্যমে ভিটগেনস্টাইনকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। এই সম্ভাব্য সংযোগগুলো প্রবন্ধে বিবেচিত আদানপ্রদানগুলোর চেয়ে আরও জটিল; যেহেতু প্রবন্ধে মূলধারার দর্শনশাস্ত্রের মূলে নিহিত অর্থ ও যোগাযোগের প্রাথমিক সমস্যাবলী সংশ্লিষ্ট আলোচনা করা হয়েছে।

[১০] যাইহোক, আমার উচিত এমন দুটি সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করা, যেগুলো নিয়ে শ্রাফার এবং গ্রামশির ধারণাগুলোর মধ্যকার অনুরূপতা কিংবা অনৈক্য আরও বেশি পুনঃঅনুসন্ধানের দাবীদার। এর মধ্যে প্রথমটি হলোঃ ভিটগেনস্টাইনের পেশ করা উক্তি “কোনো পথই নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত করা যায়না, কারণ প্রত্যেক পথ নিয়মের সাথে সঙ্গতি রেখে তৈরি হতে পারে (no course of action could be determined by a rule, because every course of action can be made to accord with the rule)” — এর বরাত দিয়ে সাউল ক্রিপকি (১৯৮২) যেটিকে বলেছেন “দ্যা ভিটগেনস্টাইনীয় প্যারাডক্স”। যেহেতু “পরবর্তীকালের ভিটগেনস্টাইন” অর্থ এবং যোগাযোগকে নিয়মের অনুবর্তী করার উপর খুব স্থিরীকৃত ছিলেন, ক্রিপকি তাই এই প্যারাডক্স বা কূটাভাসকে “সম্ভবত [ভিটগেনস্টাইনের] Philosophical Investigations-এর কেন্দ্রগত সমস্যা (পৃ. ৭)” হিসেবে চিহ্নিত করেন। দ্বিতীয় সমস্যাটি, দর্শনগত সমস্যাবলীকে দেখার “নৃতাত্ত্বিক ভঙ্গিমা”কে কি শুধু ভাষা কীভাবে ব্যবহৃত হয় তা বুঝতে ডেকে আনতে হবে নাকি ডেভিড হিউম যতদূর গিয়েছেন ততদূর পর্যন্তও যাওয়া যাবে — যখন হিউম, কেইনস এবং শ্রাফার (১৯৩৮) একটি অনুচ্ছেদে অনুমোদনক্রমে উদ্ধৃত দাবিতে বলেছেন ”জীবনের পথপ্রদর্শক” কারণ নয় বরং “প্রথা” ছিল (পৃ. XXX)। এই দুটি সমস্যা নিয়ে অধিকতর আলোচনা পাওয়া যাবে পূর্বে উল্লেখিত আমার দীর্ঘ রচনা, “Piero Sraffa: A Students Perspective”-তে, যেটি Academia Nationale dei Lincei প্রকাশ করবে।

[১১] এগুলো এবং সংশ্লিষ্ট ফলাফলের ব্যাপ্তির পরিসর এবং যথাযথ গুরুত্ব নিয়ে প্রচুর পরিমাণে মতবিরোধ রয়েছে; অন্যান্যদের মধ্যে দেখুন, রবিনসন (১৯৫৩-৫৪); রবার্ট সলো (১৯৫৫-৫৬); গ্যারেংইয়ানি (১৯৬০, ১৯৭০, ১৯৯৪); স্যামুয়েলসন (১৯৬২, ১৯৬৬); পাসিনেত্তি (১৯৬৬, ১৯৭৪); হারকোরট (১৯৭২); ডোব (১৯৭৩); ক্রিস্টোফার ব্লিস (১৯৭৫); স্টিডম্যান (১৯৭৭, ১৯৮৮); এডউইন বার্মাইষ্টার (১৯৮০); ভরদ্বাজ (১৯৯০); ভরদ্বাজ ও শেফল্ড (১৯৯০); মাউরো বারানছিনি ও জিওফ্রে হারকোরট (১৯৯৩); কজছি ও মার্খিয়োনাত্তি (২০০০); কুর্জ (১৯৯০); এবং আভি কোহেন ও জিওফ্রে হারকোরট (২০০২)।

[১২] সেন (১৯৭৪)-তে আলোচিত, সেন (১৯৮৪)-তে পুনঃমুদ্রিত।

[১৩] এই ফলাফলটি পাওয়া যায় সরল গঠনে, যেখানে কোন যুগ্ম উৎপাদন (joint production) থাকেনা। যুগ্ম উৎপাদনের উপস্থিতি সম্পর্কটিকে আরও জটিল করে তোলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অবশ্য (intractable) নয়। দেখুন, বেহট্রাম শেফল্ড (১৯৮৯)।

[১৪] সেন (১৯৭৮)-তে আমি ভেদ বা স্বাতন্ত্র্য আলোচনা করেছি। চাহিদার ভূমিকা সম্পর্কে শ্রাফা কী দাবি করেন এবং কী করেন না তার পাঠগত বিশ্লেষণের জন্য আরও দেখুন, সালভাদরি (২০০০)। শ্রাফার অনুশীলনের (প্রদত্ত দ্রব্য উৎপাদন সহকারে) প্রকৃতি অনুযায়ী এটাও পরিষ্কার কেন শ্রাফা ন্যায়ত দাবি করেন যে, তাঁর বিশ্লেষণে নিয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে এমন কোন “পরিমাণের উপর ধ্রুব লাভালাভের (Constant returns to scale)” নির্দিষ্ট পূর্বশর্ত নেই। নিরীক্ষিত বা পর্যবেক্ষিত স্ন্যাপশট ছবিটির অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজেরাই নিশ্চিতভাবে বিশেষ বাজার সম্পর্কগুলোকে (এবং এমনকি কিছু মূলগত স্থিতি) প্রতিফলিত করতে পারে, বিশেষ করে নিরীক্ষিত অভিন্ন লাভের হার এবং আসন্ন ব্যতিক্রমহীন বেতনের হার-এর জন্য। তবে শ্রাফা নিঃসন্দেহে সঠিক ছিলেন যে, নিরীক্ষিত স্ন্যাপশট ছবিটি দ্বারা ইতিমধ্যে যা ফলাফল হিসেবে দাঁড়ায় (কোন পরস্পরবিরোধী পরিবর্তন বিবেচনা করা ছাড়া) তার সঙ্গে অতিরিক্ত আর কোন পূর্বশর্ত (উদাহরণস্বরূপ, পরিমাণের উপর ধ্রুব লাভালাভের) যোগ করার প্রয়োজন হয় না।

[১৫] শ্রাফা অনুরূপ একটি প্রভেদ আলোচনা করেন একটি অপ্রকাশিত নোটে (D3/12/15:2 শ্রাফা কালেকশন, রেন গ্রন্থাগার, ট্রিনিটি কলেজ, বাঁকা হরফ করা হয়েছে), যেটি ১৯৪২ সালে লেখা হয় (এটির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করানোর জন্য আমি হাইন কুর্জ-এর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ):

এই রচনাটি (আসন্ন গ্রন্থ) অত্যন্ত প্রাথমিক একটি সমস্যার সঙ্গে জড়িত; এতই প্রাথমিক যে এর সমাধানকে সাধারণভাবে নিশ্চিত ধরে নেয়া হয়। সমস্যাটি হলো, দাম ও লাভের হারের একটি প্রণালীর সাম্যাবস্থার শর্তাবলী নিশ্চিতকরণ — এমনই একটি সাম্যাবস্থার দশা নিয়ে আসতে পারে যে প্রভাবগুলো সেগুলোর অধ্যয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে

[১৬] রবিনসন (১৯৬৪), পৃ. ৩৯।

[১৭] একটি অনুমোদিত বৈজ্ঞানিক দাবিকে যথার্থ হিসেবে গ্রহণ করতে যে পরিমাণ নির্ভূলতা প্রয়োজন হবে তার সাথে সম্পর্কিত একটি সমস্যা রয়েছে জ্ঞানতত্ত্বে। এই সমস্যাটির জন্যেও; নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স গ্রন্থের এরিস্টটলের দাবির সঙ্গে মিল রেখে, শ্রাফার বিশ্লেষণের প্রকৃতি একটি সম্বন্ধ স্থাপন করে যে, আমাদেরকে “জিনিসপত্রের প্রতিটি শ্রেণিতে ঠিক ততদূর পর্যন্তই নির্ভুলতা খুঁজতে হয় যতদূর বিষয়বস্তুর প্রকৃতি মঞ্জুর করে।“ এই সমস্যাটি নিয়ে, দেখুন সেন (১৯৮২), প্রবন্ধ ২০ (“Description as choice”), এবং কোট্‌স (১৯৯৬); দোহাই বা রেফারেন্সে উল্লেখিত উৎসসমূহ। যেকারণেই হোক, এখানে পুনরায় আমি এই প্রশ্নটি অনুসরণ করব না।

[১৮] বিশেষভাবে দেখুন [মরিস] ডোবের সহযোগিতায় শ্রাফা সম্পাদিত রিকার্ডো (১৯৫১-৭৩) এবং ডোব (১৯৭৩)।

[১৯] ডোব (১৯২৯), পৃ. ৩২। এটিও আগ্রহের সঙ্গে খেয়াল করতে হয় যে, ১৯২৫ সালের ২০শে মে’তে আরেকজন মার্ক্সীয় বুদ্ধিজীবী আর. পি .দত্তকে লেখা একটি চিঠিতে ডোব লেখেন (পিয়ের শ্রাফার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার অল্প সময় পরেই এটি লেখা হয়): “প্রান্তিক উপযোগতত্ত্ব আমার কাছে পুরোপুরি ঠিকঠাক মনে হয়, এবং দাম ও দাম পরিবর্তনের ব্যাখ্যা ক্ল্যাসিক্যাল মতবাদকে আরও সঠিকভাবে কাঠামোবদ্ধ করা এবং বিশ্লেষণের জন্যে আরও নিখুঁত সরঞ্জাম হিসেবে শাণিত হওয়ায় মাধ্যমে অত্যন্ত সহায়ক অগ্রগতি এনে দিয়েছে”। এ সম্পর্কে দেখুন, পলিট (১৯৯০)।

[২০] দেখুন শ্রাফা (১৯৬০), পৃ. v-vi।

[২১] বস্তুত, সকল কাউন্টারফ্যাক্টুয়াল যুক্তিবিচার পদ্ধতিকে অনুমোদন না দিলে শাস্ত্র হিসেবে অর্থশাস্ত্রের প্রসার অবিশ্বাস্যভাবে সীমিত হয়ে যেত, যা আমি আলোচনা করার চেষ্টা করেছি সেন (২০০২)-তে; আরও দেখুন, সেন (১৯৮২), প্রবন্ধ ২০ (Description as choice), পৃ. ৪৩২-৪৯।

[২২] যেহেতু শ্রাফার ক্ল্যাসিক বইটির (১৯৬০ সালে প্রকাশিত) উপশিরোনাম রয়েছে “Prelude to a Critique of Economic Theory”, তাই এখানে একটি ব্যাপারে অনুমান অনুসরণ করার উৎসাহ জাগে। তা হচ্ছে যখন “ক্রিটিক” — যেটির “prelude বা গৌড়চন্দ্রিকা” এই বইটি — সম্পন্ন হবে, তখন এটি দাম ও বন্টনের বিকল্প তত্ত্ব উপস্থাপন করবে এমন প্রত্যাশা করে থাকতে পারেন শ্রাফা। যদি এই প্রবন্ধে উপস্থাপিত যুক্তিগুলো সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই অনুমান ভ্রান্ত। এই সম্পর্কে শ্রাফা চেষ্টা করছিলেন অর্থশাস্ত্রগত জিজ্ঞাসাগুলোর ব্যাপ্তি ও প্রসার প্রশস্ত করতে, মূলধারার অর্থশাস্ত্রগত তত্ত্বে নিয়মিতভাবে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন উত্তর খোঁজার চেষ্টা শুধুমাত্র নয়।

[২৩] দুটি বিকল্প পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যকার হিকসিয়ান বৈপরীত্যের বিস্তৃত প্রসার রয়েছে সেন (১৯৭৩)-তে আলোচনাকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথমদিকের কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হিক্‌স (১৯৮১) উল্লেখ করেন, “আমি এখন মনে করি আমার ১৯৪০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে আমি ব্যয় পরিমাপের ব্যাপারে খুব কমই উল্লেখ করেছি“ (পৃ. ১৪৩)। জাতীয় আয়ের উপযোগ-ভিত্তিক নয়, বরং উৎপাদন-ভিত্তিক মূল্যায়নের একটি অগ্রগণ্য বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া যায় জেমস মিরলিস (১৯৬৯)-এ। যেহেতু এই মূল্যায়ন প্রকৃত আয় তুলনার (যেটি বিশুদ্ধভাবে পরস্পরবিরোধিতা চর্চা) নিরিখে উৎপাদন সম্ভাব্যতা অনুসন্ধানকে সংযুক্ত করে, তাই মিরলিসের বিশ্লেষণে, একটি প্রদত্ত উৎপাদন পরিস্থিতির জন্য ব্যয় খাতের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কগুলোর অনুসন্ধান সম্পর্কিত শ্রাফার কাজ থেকে অনেকটাই ভিন্ন দিকে পরিচালিত হয়। সাদৃশ্য শুধু দেখা যায়ঃ i) দামের কারণিক নির্ধারণের একটি সম্পূর্ণ তত্ত্ব, জাতীয় আয়ের মূল্যায়ন কিংবা উপযোগ অথবা ব্যয়ের সামাজিক বর্ণ্নের জন্য মূল্য-তত্ত্ব ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় নয়, এবং ii) উভয় চর্চায়ই উপযোগ তত্ত্ব (উপাখ্যান) থেকে ব্যয় উপাখ্যানের পৃথকীকরণ সম্পৃক্ত — এই দুটি বিষয়ে।

[২৪] শ্রাফা (১৯৬০), পৃ. v-vi দেখুন। শ্রাফা লেখেন, “১৯২৮ সালে যখন লর্ড কেইনস এই কাজটির খসড়া পড়েন, তখন তিনি সুপারিশ করেন — যদি ধ্রুব লাভালাভ (constant returns) অনুমান হিসেবে ধরে না নেয়া হয় তবে এই প্রভাবটি লক্ষ্য করে একটি জোরালো সতর্কীকরণ প্রদান করতে হবে” (পৃ. vi)। সেই “জোরালো সতর্কীকরণ”টি দেখতে পাওয়া যায় শ্রাফা (১৯৬০)-এর মুখবন্ধতে।

সংযুক্তিঃ

  • ভিটগেনস্টাইনের কাজ নিয়ে বোধিচিত্ত বেশ কয়েকটি আলাপের আয়োজন করেছিল। সে আলাপগুলোর ধারণকৃত ভিডিও বোধিচিত্তের ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যায়। প্রিয়ম্বদা সরকার আলাপ করেছিলেন ট্রাকটেটাসের ভিটগেনস্টাইন অর্থাৎ প্রথমদিককার ভিটগেনস্টাইনকে নিয়ে। সাহিদ সুমন দুই পর্বে আলাপ করেছিলেন উভয় পর্বের ভিটগেনস্টাইনের কাজ নিয়ে। সৈয়দ নিজারের আলোচনাতেও ভিটগেনস্টাইনের ভাবনা নিয়ে তুলনামূলকভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। তিন আলোচকই “অর্থের ছবিতত্ত্ব বা চিত্রতত্ত্ব” সংক্রান্ত বোঝাপড়া নিয়ে বেশ সমালোচনা করেছেন। তাছাড়া, ভিটগেনস্টাইনের কাজ নিয়ে বাংলাভাষায় ইতিমধ্যেই বেশকিছু বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে, প্রয়োজনবোধে সেগুলোর সাহায্য নেওয়া যায়।
  • মার্ক্স, হাইডেগার, ভিটগেনস্টাইন সহ বেশকিছু দার্শনিকের কাজকে দুই বা ততোধিক পর্বে ভাগ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই একজন দার্শনিক পূর্বোক্ত অবস্থান ছেড়ে নতুন অবস্থান নেন। এরকম ক্ষেত্রে দার্শনিক অবস্থানকে সহজে চিহ্নিত করতে ইংরেজিতে আর্লি (early) ও লেটার (later) অভিধা যোগ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলায় এদেরকে অনুবাদ করা হয় যথাক্রমে “তরুণ” ও “পরিণত”, যদিও কাঁচা-পাকা, পরিণত-অপরিণত অর্থে বিভাজন টানা হয়নি। এধরনের অনুবাদের অন্তর্নিহিত সমস্যা এড়াতে অনুবাদকদ্বয় ভিটগেনস্টাইনের বেলায় ব্যবহার করেছেনঃ প্রথমদিককার বা ট্রাকটেটাসের ভিটগেনস্টাইন এবং পরবর্তীকালের বা উত্তর-পর্বের বা ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশন্সের ভিটগেনস্টাইন।
  • গ্রামশিকে নিয়ে বোধিচিত্তের আয়োজিত সেমিনারে গ্রামশির কাজের নানান দিক উঠে এসেছে। তন্মধ্যে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান শ্রাফা ও গ্রামশির যোগ নিয়ে আলাপের সূত্রপাত করেছিলেন। এছাড়াও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দেখা যেতে পারে গ্রামশির রচনাবলির নির্বাচিত অংশ ও চিঠিপত্রের বঙ্গানুবাদ, গ্রামশির কাজ নিয়ে লিখিত প্রবন্ধের সংকলন গ্রন্থগুলো।

দোহাই

[পাওলো আলবানি] Albani, Paolo. 1998. “Sraffa and Wittgenstein: Profile of an Intellectual Friendship,” Hist. Econ. Ideas 6:3, pp. 151–73.

[মাউরো বারানছিনি ও জিওফ্রে সি. হারকোরট] Baranzini, Mauro and Geoffrey C. Harcourt, eds. 1993. The Dynamics of the Wealth of Nations: Growth, Distribution and Structural Change: Essays in Honour of Luigi Pasinetti. NY: St. Matin’s Presss.

[কৃষ্ণ ভরদ্বাজ] Bharadwaj, Krishna. 1988. “Sraffa’s Ricardo,” Cambridge J. Econ. 12:1, pp. 67–84.

— — — , 1990. “Sraffa’s Return to Classical Theory,” in Bharadwaj and Schefold (1990). pp. 53–81

[কৃষ্ণ ভরদ্বাজ ও বেহট্রাম শেফল্ড] Bharadwaj, Krishna and Bertram Schefold, eds. 1990. Essays on Piero Sraffa: Critical Perspectives on the Revival of Classical Theory. London: Routledge.

[সাইমন ব্ল্যাকবার্ন] Blackburn, Simon. 1994. Dictionary of Philosophy. NY: Oxford U. Press.

[ক্রিস্টোফার জে. ব্লিস] Bliss, Christopher J. 1975. Capital Theory and the Distribution of Income. Amsterdam: North-Holland.

[এডউইন বার্মাইষ্টার] Burmeister, Edwin. 1980. Capital Theory and Dynamics. Cambridge: Cambridge U. Press.

[এডওয়ার্ড এইচ. চ্যম্বারলিন] Chamberlin, Edward H. 1933. The Theory of Monopolistic Competition. Cambridge, MA: Harvard U. Press.

[জন কোট্‌স] Coates, John. 1996. The Claims of Common Sense: Moore, Wittgenstein, Keynes and the Social Sciences. Cambridge: Cambridge U. Press. Digital ed., 2001.

[আভি কোহেন ও জিওফ্রে সি. হারকোরট] Cohen, Avi and Geoffrey C. Harcourt. 2002. “Whatever Happened to the Cambridge Capital Theory Controversies,” J. Econ. Perspect. 17:1, pp. 199–214.

[তেরেনজিও কজছি ও রবার্তো মার্খিয়োনাত্তি] Cozzi, Terrenzio and Roberto Marchionatti, eds. 2000. Piero Sraffa’s Political Economy: A Centenary Estimate. London: Routledge.

[জন বি. ডেভিস] Davis, John B. 1993. “Sraffa, Interdependence and Demand: The Gramscian Influence,” Rev. Polit. Econ. 5:1, pp. 22–39.

— — — , 2002. “Garmsci, Sraffa, and Wittgenstein: Philosophical Linkages,” Europ. J. Hist. Econ. Thought 9:3, pp. 384–401.

[মরিস ডোব] Dobb, Maurice H. 1929. “A Sceptical View of the Theory of Wages,” Econ. J. 39:156, pp. 506–19.

— — — , 1937. Political Economy and Capitalism. London: Routledge.

— — — , 1955. On Economic Theory and Socialism: Collected Papers. London: Routledge.

— — — , 1973. Theories of Value and Distribution since Adam Smith: Ideology and Economic Theory. Cambridge: Cambridge U. Press.

[জন ইওয়াল, মুরে মিলগেট এবং পিটার নিউম্যান] Eatwell, John; Murray Milgate and Peter Newman, eds. 1987. The New Palgrave: A Dictionary of Economics. London: Macmillan.

— — — , 1990. Capital Theory. London: Macmillan.

[জন ইওয়াল ও কার্লো পানিকো] Eatwell, John and Carlo Panico. 1987. “Sraffa, Piero (1898–1983),” in Eatwell, Milgate and Newman op. cit., pp. 445–52.

[পিয়েরাঞ্জোলো গ্যারেংইয়ানি] Garegnani, Pierangelo. 1960. Il capitale nelle teorie della distribuzione. Milan: Giuffrè.

— — — , 1970. “Heterogeneous Capital, the Production Function and the Theory of Distribution,” Rev. Econ. Stud. 37:3, pp. 407–36.

— — — , 1990. “Quantity of Capital,” in Eatwell, Milgate and Newman op. cit.

— — — , 1998. “Sraffa: The Theoretical World of the ‘Old Classical Economists’,” Europ. J. Hist. Econ. Thought 5:3, pp. 415–29.

[আন্তোনিও গ্রামশি] Gramsci, Antonio. 1957. The Modern Prince and Other Writings. London: Lawrence Wishart.

— — — , 1971. Selections from the Prison Notebooks of Antonio Gramsci. Quintin Hoare and Geoffrey Nowell Smith, eds. London: Lawrence Wishart.

— — — , 1975. Letters from Prison. Lynne Lawner, trans. and ed. London: Jonathan Cape.

[ফ্রাঙ্ক এইচ. হান] Hahn, Frank H. 1982. “The Neo-Ricardians,” Cambridge J. Econ. 6:4, pp. 353–74.

[জিওফ্রে সি. হারকোরট] Harcourt, Geoffrey C. 1972. Some Cambridge Controversies in the Theory of Capital. Cambridge: Cambridge U. Press.

[জন হিক্‌স] Hicks, John. 1940. “The Valuation of Social Income,” Economica 7, pp. 104–24.

— — — , 1981. Wealth and Welfare: Collected Essays on Economic Theory, vol. 1. Oxford: Blackwell.

[নিকোলাস ক্যালডোর] Kaldor, Nicholas. 1984. “Piero Sraffa,” Cambridge J. Econ. 8:1, pp. 1–5.

— — — , 1985. “Piero Sraffa (1898–1983),” Proceedings British Academy 71, pp. 615–40.

[জন মেয়নার্ড কেইনস] Keynes, Johan Maynard and Piero Sraffa. 1938. “Introduction,” in An Abstract of a Treatise of Human Nature 1740, A Pamphlet Hitherto Unknown by David Hume. John M. Keynes and Piero Sraffa, eds. Cambridge: Cambridge U. Press.

[সাউল ক্রিপকি] Kripke, Saul A. 1982. Wittgenstein on Rules and Private Language. Cambridge, MA: Harvard U. Press.

[হাইন ডি. কুর্জ] Kurz, Heinz D. 1990. Capital, Distribution and Effective Demand: Studies in the Classical Approach to Economic Theory. Cambridge: Polity Press.

— — — , ed. 2000. Critical Essays on Piero Sraffa’s Legacy in Economics. Cambridge: Cambridge U. Press.

[হাইন ডি. কুর্জ এবং নেরি সালভাদরি] Kurz, Heinz D. and Neri Salvadori. 2000. “Piero Sraffa’s Contributions to Economics: A Brief Survey,” in Kurz op. cit., pp. 3–24.

[ব্রায়ান ম্যাগানিজ] McGuinness, Brian, ed. 1982. Wittgenstein and His Times. Oxford: Blackwell.

[জেমস মিরলিস] Mirrlees, James A. 1969. “The Evaluation of National Income and an Imperfect Economy,” Pakistan Devel. Rev. 9:1, pp. 1–13.

[রে মঙ্ক] Monk, Ray. 1991. Ludwig Wittgenstein: The Duty of Genius. London: Vintage.

[নেরিও নালদি] Naldi, Nerio. 2000. “Piero Sraffa and Antonio Gramsci: The Friendship Between 1999 and 1927,” Europ. J. Hist. Econ. Thought 7:1, pp. 79–114.

[লুইজি এল. পাসিনেত্তি] Pasinetti, Luigi L. 1966. “Changes in the Rate of Profit and Switching of Techniques,” Quart. J. Econ. 80:4, pp. 503–17.

— — — , 1969. “Switches of Techniques and the ‘Rate of Return’ in Capital Theory,” Econ. J. 79, pp. 508–25.

— — — , 1974. Growth and Income Distribution. Cambridge: Cambridge U. Press.

— — — , 1977. Lectures on the Theory of Production. London: Macmillan.

— — — , 1979. “Sraffa, Piero,” Int. Encyclopaedia Social Sciences vol. 18. NY: Macmillan.

— — — , 1988. “Sraffa on Income Distribution,” Cambridge J. Econ. 12:1, pp. 135–38.

[ব্রায়ান এইচ. পলিট] Pollit, Brian H. 1990. “Clearing the Path for ‘Production of Commodities by Means of Commodities’: Notes on the Collaboration of Maurice Dobb in Piero Sraffa’s edition of the Works and Correspondence of David Ricardo,” in Bharadwaj and Schefold op. cit.

[জঁ-পিয়ের পোটি] Potier, Jean-Pierre. 1987. Piero Sraffa — Unorthodox Economist (1898–1983): A Biographical Essay. London and NY: Routledge.

[ডেভিড রিকার্ডো] Ricardo, David. 1951–73. The Works and Correspondence of David Ricardo. 11 vols. Piero Sraffa, ed. with Maurice H. Dobb. Cambridge: Cambridge U. Press.

[জোয়ান রবিনসন] Robinson, Joan. 1933. The Economics of Imperfect Competition. London: Macmillan.

— — — , 1953–54. “The Production Function and the Theory of Capital,” Rev. Econ. Stud. 21:2, pp. 81–106.

— — — , 1961. Prelude to a Critique of Economic Theory,” Oxford Econ. Pap. 13:1, pp. 53–58.

— — — , 1964. Economic Philosophy. Harmondsworth: Penguin.

[আলেসান্দ্রো রঙ্কালিয়া] Roncaglia, Alessandro. 1978. Sraffa and the Theory of Prices. NY: Wiley. 2nd ed., 1981.

— — — , 1999. Sraffa: la biografia, l’opera, le scoule. Bari: Laterza.

[নেরি সালভাদরি] Salvadori, Neri. 2000. “Sraffa on Demand: A Textual Analysis,” in Kurz op. cit., pp. 181–97.

[পল স্যামুয়েলসন] Samuelson, Paul A. 1938. “A Note on the Pure Theory of Consumers’ Behaviour,” Economica 5, pp. 61–71.

— — — , 1962. “Parable and Realism in Capital Theory: The Surrogate Production Function,” Rev. Econ. Stud. 29:3, pp. 193–206.

— — — , 1966. “A Summing Up,” Quart. J. Econ. 80:4, 568–83.

— — — , 1987. “Sraffian Economics,” in Eatwell, Milgate and Newman op. cit.

— — — , 2000a. “Revisionist Findings on Sraffa,” in Kurz op. cit, pp. 25–45.

— — — . 2000b. “Sraffa’s Hits and Misses,” in Kurz op. cit., pp. 111–52.

[বেহট্রাম শেফল্ড] Schefold, Bertram. 1989. Mr. Sraffa on Joint Production and Other Essays. London: Unwin Hyman.

— — — , 1996. “Piero Sraffa 1898–1983,” Econ. J. 106:438, pp. 1314–25.

[অমর্ত্য সেন] Sen, Amartya K. 1974. “On Some Debates in Capital Theory,” Economica 41, pp. 325–35.

— — — , 1978. “On the Labour Theory of Value: Some Methodological Issues,” Cambridge J. Econ. 2, pp. 175–90.

— — — , 1979. “The Welfare Basis of Real Income Comparisons: A Survey,” J. Econ. Lit. 17, pp. 1–45.

— — — , 1982. Choice, Welfare and Measurement. Oxford: Blackwell. Repub., Cambridge, MA: Harvard U. Press, 1997.

— — — , 1984. Resources, Values and Development. Cambridge, MA: Harvard U. Press.

— — — , 2002. Rationality and Freedom. Cambridge. MA: Harvard U. Press.

[অ্যাডাম স্মিথ] Smith, Adam. 1776. An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations. Repub., Oxford: Oxford U. Press, 1976.

[রবার্ট এম. সলো] Solow, Robert M. 1955–56. “The Production Function and the Theory of Capital,” Rev. Econ. Stud. 23:2, pp. 101–108.

— — — , 1963. Capital Theory and the Rate of Return. Amsterdam: North-Holland.

[পিয়ের শ্রাফা] Sraffa, Piero. 1925. “Sulle relazioni fra costo e quantita prodotta,” Annali di Econ. 2, pp. 277–328. English trans. by John Eatwell and Alessandro Roncaglia in Luigi L. Pasinetti, ed., Italian Econ. Papers vol. 3. Bologna: Il Mulino, and Oxford: Oxford U. Press, 1998.

— — — , 1926. “The Laws of Return under Competitive Conditions,” Econ. J. 36:144, pp. 535–50.

— — — , 1951. “Introduction,” in Ricardo (1951–73) op. cit., vol. I, pp. xiii–lxii.

— — — , 1960. Production of Commodities by Means of Commodities: Prelude to a Critique of Economic Theory. Cambridge: Cambridge U. Press.

[ইন স্টিডম্যান] Steedman, Ian. 1977. Marx After Sraffa. London: New Left Books. Repub., London: Verso, 1981.

— — — , 1988. Sraffian Economics. 2 vols. Aldershot: Elgar. Sylos Labini, Paolo. 1990. “Sraffa’s Critique of the Marshallian Theory of Prices,” in Bharadwaj and Schefold op. cit., pp. 3–19.

Walsh, Vivian; and Harvey Gram. 1980. Classical and Neoclassical Theories of General Equilibrium. NY: Oxford U. Press.

[লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন] Wittgenstein, Ludwig. 1921. Tractatus Logico-Philosophicus. Trans. David Pears and Brian McGuinness. NY: Routledge, 1961.

— — — , 1953. Philosophical Investigations. Oxford: Blackwell. 2nd ed. 1958.

— — — , 1958. The Blue and Brown Books. Oxford: Blackwell.

প্রকাশঃ ১২ই আষাঢ়, ১৪২৮:::২৬শে জুন, ২০২১

Link: https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%A6/%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A6%AB-%E0%A6%AD%E0%A6%9F%E0%A6%97%E0%A6%A8%E0%A6%B8%E0%A6%9F%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A6%8F%E0%A6%AC-%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%B6-%E0%A6%85%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%AF-%E0%A6%B8%E0%A6%A8

--

--

বোধিচিত্ত

বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার প্রয়াস। A South Asian Platform for Interdisciplinary Studies. Based in Dhaka.